রিয়ালের হ্যাজার্ড যেন বার্সেলোনার কুতিনিও

রিয়াল ও বার্সার দুই মাথাব্যথা!ছবি: টুইটার

হ্যাজার্ডের একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলেছে। চ্যাম্পিয়নস লিগে কালই সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সফল দলটির কালকের পারফরম্যান্স দেখে এ ফলকে অপ্রত্যাশিত বলার কোনো সুযোগ নেই। দলের সবচেয়ে বড় না হলেও ব্যয়বহুল তারকা এডেন হ্যাজার্ডের পারফরম্যান্সও ছিল দলের মতোই। এমনই সে পারফরম্যান্স, যা মনের ভুলেও আরেকবার দেখার ইচ্ছা জাগবে না।

এমন এক ম্যাচ আর এমন এক পারফরম্যান্স শেষে হ্যাজার্ড গিয়েছিলেন চেলসির খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতে। রিয়াল মাদ্রিদের দলবদলের রেকর্ড সাইনিং হওয়ার আগে চেলসিতেই যে সাত বছর খেলেছেন। তাই সাবেক সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। মাঠে না নামা ডিফেন্ডার কুর্ত জুমার কোনো এক কথায় বেশ এক গাল হেসেছেন। একেবারে আনন্দে আটখানা হয়ে হ্যাজার্ডের ভেঙে পড়ার সে ছবি দেখেই রিয়াল সমর্থকেরা খেপেছেন। দলের হারের পর এমন হাসি তাঁদের ভালো লাগেনি।

রিয়ালকে অবশ্য এ ছবির চেয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলবে হ্যাজার্ডের অন্য একটি দিক। এখন পর্যন্ত যে ইঙ্গিত, তাতে হ্যাজার্ড রিয়ালের জন্য ঠিক ততটাই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারেন, ঠিক যতটা বার্সার জন্য বয়ে এনেছেন ফিলিপে কুতিনিও।

হ্যাজার্ড।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

স্পেনের সেরা দুই ক্লাবে দুজনের ক্যারিয়ারের যে গতিপথ, তাতে অবিশ্বাস্য মিল দেখা যাচ্ছে এখন পর্যন্ত। ২০১৭ সালে নেইমার বার্সাকে হতভম্ব করে দিয়ে পিএসজিতে চলে যান। তাঁর শূন্যতা পূরণ করতে তাঁরই স্বদেশিকে পছন্দ হয়েছিল বার্সার। কিন্তু লিভারপুলে সে দলবদলে ছাড়তে রাজি হয়নি। ফলে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে উসমান দেম্বেলেকে টেনে নিয়ে আসে বার্সেলোনা। তবু মেসির সতীর্থ হওয়ার জন্য কুতিনিওর গোঁ ছাড়ানো যায়নি। ফলে ছয় মাস পরই বার্সেলোনার দলবদলের রেকর্ড আবার ভাঙতে দেখা গেল। ১২০ মিলিয়ন ইউরো (শর্ত সাপেক্ষে ১৬০ মিলিয়ন) দিয়ে তাঁকে নিয়ে গেল বার্সা।

এবার হ্যাজার্ডের দিকে নজর দেওয়া যাক। নেইমারের শূন্যস্থান পূরণ করতে কুতিনিওকে নিয়েছে বার্সেলোনা। সে তুলনায় রিয়ালের শূন্যস্থান আরও বড় ছিল, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অভাবকে শূন্যস্থান বলেও বোঝানো যায় না। ২০১৮ বিশ্বকাপের পর রিয়াল ছেড়ে চলে গেলেন রোনালদো। তাঁর জায়গা বিশ্বকাপের সেরা তিন খেলোয়াড়ের একজন, হ্যাজার্ডকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিল রিয়াল। চেলসি অবিশ্বাস্য এক মূল্য গায়ে সাঁটিয়ে দেওয়ায় সে যাত্রা আর হ্যাজার্ডকে রিয়ালে দেখা যায়নি। কিন্তু এক বছর পর জিনেদিন জিদানের উপস্থিতি হ্যাজার্ডকে আবার রিয়ালমুখী করেছে। চুক্তিতে মাত্র এক বছর বাকি থাকার পরও হ্যাজার্ডের জন্য ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি খরচ করতে হয়েছে রিয়ালকে। রোনালদো ও বেলকে টপকে রিয়ালের সবচেয়ে দামি ফুটবলার ওতেই হয়ে গেছেন। শর্ত সাপেক্ষে রিয়াল নাকি চেলসিকে আরও প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউরোও দিতে পারে, এমনটাও শোনা যায়।

বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর প্রথম কিছুদিন খারাপ করেননি কুতিনিও। সে সময়ের নিয়ম অনুযায়ী মাঝ মৌসুমে দল বদল করায় চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে পারেননি। তবে প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়া লা লিগা জয়ে কিছুটা অবদান রেখেছিলেন। পরের মৌসুমেও লিগ জিতেছেন বার্সেলোনার জার্সিতে। তবে তাতে তাঁর নিজের কোনো অবদান ছিল না। কোচ আরনেস্তো ভালভার্দে একের পর এক ম্যাচে তাঁকে সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। ৩৪ ম্যাচে মাত্র ৫ গোল করেছেন, সতীর্থদের করিয়েছেন দুই গোল। দলে মেসি থাকায় নিজের পছন্দের ‘ফ্রি রোলে’ খেলতে না পারায় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন।

কুতিনিও।
ফাইল ছবি: এএফপি

এর মধ্যেই ধাক্কা হয়ে এসেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। লিভারপুল ছেড়ে এসেছিলেন, সেই লিভারপুলের বিপক্ষেই খেলতে হয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল। দুই লেগেই মাঠে ছিলেন ঘণ্টাখানেক। ম্যাচে কোনো অবদান রাখেননি। আর ক্ষতে লবণের ছিটা লাগিয়ে বার্সেলোনাকে হারিয়ে ফাইনাল চলে গেল লিভারপুল। মেসির সঙ্গী হয়ে ইউরোপ সেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। আর সেখানে তাঁকে দর্শক বানিয়েই চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে গেল লিভারপুল!

এর মধ্যেই ধাক্কা হয়ে এসেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। লিভারপুল ছেড়ে এসেছিলেন, সেই লিভারপুলের বিপক্ষেই খেলতে হয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল। দুই লেগেই মাঠে ছিলেন ঘণ্টাখানেক। ম্যাচে কোনো অবদান রাখেননি। আর ক্ষতে লবণের ছিটা লাগিয়ে বার্সেলোনাকে হারিয়ে ফাইনাল চলে গেল লিভারপুল। মেসির সঙ্গী হয়ে ইউরোপ সেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। আর সেখানে তাঁকে দর্শক বানিয়েই চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে গেল লিভারপুল!

পরের মৌসুমে তাঁকে আর দলেই রাখল না বার্সেলোনা। ধারে পাঠিয়ে দিল বায়ার্ন মিউনিখে। সেখানে যে খুব ভালো করেছেন তা নয়, তবে বার্সেলোনার জার্সির চেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন। বায়ার্নের হয়ে জিতেছেন ঘরোয়া লিগ ও কাপ। লিগে ২৩ ম্যাচে ১৪ গোলে অবদান রেখেছেন। আর স্বপ্নের চ্যাম্পিয়নস লিগটাও জিতে এসেছেন। ৩ গোল করে ও ৩ গোল করিয়ে সে জয়ে অবদানও রেখেছেন। বার্সেলোনার সমর্থকদের জ্বলুনি বাড়াবে অন্য তথ্য। এর মধ্যে ২ গোল আর ১ অ্যাসিস্ট যে বার্সেলোনার বিপক্ষেই। গত মৌসুমের সেই বিখ্যাত ৮-২ গোলে বার্সেলোনাকে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচেই কুতিনিও নিজের সেরাটা দেখিয়েছিলেন।

এ মৌসুমে বার্সায় ফেরার পর আবারও সেই কুতিনিও। চোটে পড়ার আগে লিগে ১২ ম্যাচ খেলেছেন। ৪টি গোলে অবদান রাখলেও কোচ রোনাল্ড কোমানের আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বার্সেলোনার সবচেয়ে দামি ফুটবলার সাড়ে তিন বছরে ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন ৯০ ম্যাচ। ৫৬২০ মিনিট মাঠে ছিলেন। অবদান রেখেছেন দলের ৩৭ গোলে। প্রতিটি দলবদলের মৌসুম শুরু করছেন বিক্রির তালিকায় যুক্ত হওয়ার খবর দিয়ে।

হ্যাজার্ডের এই রূপ দেখে রাগ করেছেন মাদ্রিদ সমর্থকেরা।
ছবি: টুইটার

এডেন হ্যাজার্ডও কম যাচ্ছেন না। রিয়াল মাদ্রিদে খেলা নিজের স্বপ্ন বলে জানিয়েছিলেন। যোগ দিয়েই স্বপ্নপূরণ বলে ধরে নিয়েছেন। প্রাক্‌–মৌসুমে স্থূলকায় এক হ্যাজার্ড দেখা দিয়েছেন। ফলে চোটে পড়তেও সময় লাগেনি। একের পর এক চোট তাঁকে এতটাই ব্যস্ত রাখল যে লিগে মাত্র ১৬ ম্যাচ খেলেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছেন ৬ ম্যাচ। পুরো মৌসুমে মাত্র ১ গোল আর ৭টি গোল বানিয়ে দেওয়া ছাড়া তাঁর কাছ থেকে কিছু পায়নি রিয়াল। তবু রিয়ালের অন্য খেলোয়াড়রা লিগ ও স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতিয়ে তাঁর ব্যর্থতা ভুলিয়ে দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় মৌসুমে হ্যাজার্ড নিজের দাম মেটাবেন বলে আশা করছিল রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু চোটের সঙ্গে সখ্য পাতানো হ্যাজার্ড সে পথে হাঁটলে তো! এ মৌসুমে লিগে আর চার ম্যাচ বাকি, এর মধ্যে মাত্র ১১টি ম্যাচে দেখা গেছে তাঁকে। দুটি গোল করেছেন, সতীর্থদের দিয়ে কিছু করাতে পারেননি। চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছেন পাঁচ ম্যাচ। তাতে এক গোল। যদিও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দৌড়ে খেটে মরেছেন শুধু, কাজের কাজ কিছু করেননি। রিয়ালের জার্সিতে এখন পর্যন্ত তাঁর ক্যারিয়ার ৪০ ম্যাচ আর ২৩৮৯ মিনিটের। তাতে ১১টি গোলে অবদান। এই তুলনায় কুতিনিও তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন।

এর মধ্যেই কাল রাতে হ্যাজার্ডের অমন আচরণ শুধু ভক্তদের খেপিয়েছে তা নয়, রিয়ালের কর্তাব্যক্তিদেরও খেপিয়েছে। ইএসপিএন জানিয়েছে হ্যাজার্ডের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ ওপর মহলে অনেক ক্রোধ সৃষ্টি করেছে। তাঁকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। কুতিনিওর ক্ষেত্রে দেড় মৌসুম পরে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বার্সেলোনা। কিন্তু দুই বছর পরও এখনো তাঁকে বিক্রি করতে পারেনি বার্সা। হ্যাজার্ডের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হওয়ার সম্ভাবনা।

রিয়াল-বার্সা সমর্থকদের যা দুঃখ দিচ্ছে, সেটাই আনন্দের কারণ হয়ে উঠেছে চেলসি-লিভারপুলের জন্য। নিজেদের সেরা তারকাকে হারানো যে দুই দলের জন্যই শাপেবর হয়ে উঠেছে। কুতিনিওর সুবাদে পাওয়া অর্থ দিয়ে সেই দলবদলেই ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইককে কিনেছিল লিভারপুল। বাকি অর্থের সদ্ব্যবহার করে গ্রীষ্মের দলবদলে গোলরক্ষক আলিসন বেকারকে নিয়ে নেয় লিভারপুল। এ দুজনের উপস্থিতি ২০১৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দিয়েছে লিভারপুলকে। পরের মৌসুমে অল রেডদের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ জয়ের ভিত্তিও এই দুই খেলোয়াড় তথা কুতিনিওর দলবদলে পাওয়া অর্থের সুবাদে।

চেলসিও কি সে পথেই এগোচ্ছে না? হ্যাজার্ডকে বিক্রি করার মৌসুমে দলবদলের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কাউকে কিনতে পারেনি চেলসি। সে সুবাদে হাতে বেশ অর্থ জমেছে তাদের। করোনার কারণে দলবদলের বাজারে সবাই যেখানে হাত গুটিয়ে বসেছিল, সেখানে তারা আক্রমণভাগের জন্যই হাকিম জিয়েশ, টিমো ভের্নার ও কাই হাভার্টজকে কিনেছে। এই তিনজনের পেছনে খরচ করা ১৭৩ মিলিয়ন ইউরোর অনেকটাই হ্যাজার্ডের দলবদলের অর্থ দিয়েই পুষিয়ে নিয়েছে তারা। সেই চেলসি এরই মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদকে উড়িয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠে গেছে প্রাণবন্ত সেই আক্রমণভাগের কারণেই। ওদিকে হ্যাজার্ডের দলের আক্রমণভাগের খেলা ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল।

হ্যাজার্ডের দলবদল আক্ষরিক অর্থেই বার্সার কুতিনিওর মতোই রূপ পাচ্ছে দিন দিন!