রোনালদো–নেইমাররা কেন নিজের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন

রোনালদো, রুনি, নেইমাররা নিজের আত্মজীবনী বানানোর দিকে ঝুঁকছেনগ্রাফিকস : প্রথম আলো
একের পর এক ফুটবলারকে নিয়ে তথ্যচিত্র হচ্ছে, চলচ্চিত্রও। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে হয়েছে অনেক আগেই, স্টিভেন জেরার্ডকে নিয়েও। সম্প্রতি নেইমারকে নিয়ে তিন পর্বের সিরিজ এসেছে নেটফ্লিক্সে। এর কদিন পরই আমাজন প্রাইমে রুনিকে নিয়ে তথ্যচিত্র। নেটফ্লিক্সে রোনালদোর বান্ধবী জর্জিনাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে দেখা হয়েছে রোনালদোর সঙ্গে তাঁর জীবন, সঙ্গে রোনালদোরও। এমনিতেই মহাবিখ্যাত এই খেলোয়াড়েরা কেন তাঁদের জীবনের গল্প নিজেরাই পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চাইছেন? দ্য অ্যাথলেটিক এ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য দুই পর্বে সেই লেখার অনূদিত রূপ।

আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত শীর্ষস্থানীয় কোনো ফুটবলার এখন দামি গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি কিংবা প্রাইভেট জেটের মতো বিষয়গুলোকে আর অপরিহার্য বলে মনে করেন না। তাঁদের কাছে এখন মর্যাদার প্রতীক হলো নিজেকে নিয়ে বানানো কোনো প্রামাণ্যচিত্র, কোনো চলচ্চিত্র, যার মাধ্যমে নিজের গল্প সবাইকে বলা যায়, যার মাধ্যমে বাইরের মানুষ বুঝতে পারে, তারকা সত্তার আড়ালে আসলে কেমন মানুষ লুকিয়ে আছে।

ওয়েইন রুনিকে নিয়ে বানানো একটা তথ্যচিত্র সম্প্রতি আমাজন প্রাইম অ্যাকাউন্টে চলে এসেছে নেইমারকে নিয়ে নেটফ্লিক্সের তিন পর্বের প্রামাণ্যচিত্র মুক্তি পাওয়ার ঠিক পরপর। তথ্যচিত্রের যে তালিকায় এর আগেই যোগ হয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, সের্হিও রামোস, স্টিভেন জেরার্ড, দিয়েগো সিমিওনের মতো আরও অনেক খেলোয়াড়।

রোনালদোর সঙ্গে জর্জিনা
ফাইল ছবি

এমনও হচ্ছে, শীর্ষস্থানীয় একজন ফুটবলারের জীবনে কী চলে, সেটা জানাতে আপনার ফুটবলার হওয়ারও দরকার নেই। একজন ফুটবলারের সঙ্গে বসবাস করলেই চলে। সম্প্রতি রোনালদোর বান্ধবী জর্জিনা রদ্রিগেজকে নিয়ে নেটফ্লিক্স ছয় পর্বের একটা তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে। নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, এই তথ্যচিত্রে জর্জিনার জীবনের গভীর প্রতিফলন দেখা যাবে।

এগুলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রশ্নটা অবধারিতভাবে মনে জাগে, সেটা হলো, কেন? তথ্যচিত্রগুলো কেন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটা নয়, বরং কেন তারকারা এসব তথ্যচিত্রের মূল চরিত্র হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন? তাঁরা তো এমনিতেই অনেক বিত্তশালী, জনপ্রিয় ও সফল। তথ্যচিত্র বানানোর জন্য প্রতিনিয়ত তাঁদের পিছু পিছু যদি ক্যামেরা নিয়ে মানুষজন ছোটাছুটি না-ও করেন, তা-ও তাঁরা তেমনই থাকবেন, অবস্থার পরিবর্তন হবে না কোনো। এত কিছু সত্ত্বেও শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়াবিদেরা কেন নিজের জীবন নিয়ে বানানো তথ্যচিত্রের জন্য এত সময় দিচ্ছেন, আলোচনায় বসছেন?

জর্জিনার জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্রটি দেখা যাবে নেটফ্লিক্সে
ছবি : টুইটার

এ ব্যাপারে দ্য অ্যাথলেটিক যাঁদের প্রশ্ন করেছে, সবাই মোটামুটি একই জবাব দিয়েছেন, ‘নিয়ন্ত্রণ। জীবনে কী চলছে, তা নিয়ে নিজের কথা, ভাবমূর্তি, দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখার একটা প্রচেষ্টা থেকেই আসছে ব্যাপারগুলো।’


এই খেলোয়াড়ের অধিকাংশই সেই ছোটবেলা থেকে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছেন। বহু বছর ধরে তাঁদের নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। এই তারকাদের কিছু ব্যাপার নিয়ে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন অনেকে সেই ভ্রান্ত ধারণাগুলোকেই সত্যি বলে মনে করেন। ফলে এই খেলোয়াড়দের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, সেটা অনেক সময় খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তথ্যচিত্র বানানোর ব্যাপারটা তাই তাঁদের কাছে ওসব ভ্রান্ত ধারণা পালটে দেওয়ার একটা সুযোগ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

স্টিভেন জেরার্ড
ফাইল ছবি

২০১৮ সালে স্টিভেন জেরার্ডকে নিয়ে বানানো চলচ্চিত্র ‘মেক আস ড্রিম’-এর পরিচালক স্যাম ব্লেয়ার এ ব্যাপারে বলেন, ‘আসলে তাঁদের জীবনটাই একেকটা গল্প। এখানে যেমন জেরার্ডের জীবন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে সব সময় এমন কিছু মহাজাগতিক গল্পগাথা প্রচার করা হয়, যার ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’
ওয়েইন রুনিকে নিয়ে বানানো তথ্যচিত্রের পরিচালক ম্যাট স্মিথ যেমন বলছেন, ‘তাঁরা অনেক অল্প বয়সে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছিলেন। তখন থেকেই তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন খবর, প্রতিবেদন করা শুরু হয়েছে। তথ্যচিত্র বানানোর ব্যাপারটা তাঁদের জন্য নিজের গল্প নিজের ভাষায় সবার সামনে তুলে ধরার একটা সুযোগ। নিজের কাহিনির ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের চেষ্টাও।’


নিজেকে নিয়ে বানানো চলচ্চিত্রে রুনি নিজেই বলেছেন, জনমনে তাঁর যে ভাবমূর্তি হয়েছে, সেটার পেছনে একের অধিক নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব আছে। তিনি মনে করেন, ঘটনাগুলো তাঁর নামের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছে, মানুষ হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে ফুটবলারদের এমন মনোভাব এ প্রশ্নেরও জন্ম দেয়, সাধারণ মানুষ তাঁদের কাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করবে না তো কীসের ভিত্তিতে করবে? রুনির মতে, অত ছোট বয়সে তাঁকে যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, মানুষ সেটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁর বয়সের ব্যাপারটা মাথায় রাখে না। তাই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের ব্যাপারটাকে নিজেকে নিয়ে কিছু বিষয় পরিষ্কার করার মাধ্যম হিসেবেও দেখছেন রুনি।

ওয়েইন রুনি
ছবি : রয়টার্স

এজেন্সি কিনের প্রতিষ্ঠাতা সিমোন অলিভিয়েরার ডেভিড বেকহামের সঙ্গে ১৫ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি দ্য অ্যাথলেটিককে জানিয়েছেন, ‘আগে ট্যাবলয়েডের জমানায় খেলোয়াড়দের মধ্যে এ ভয় কাজ করত যে বাসায় মিডিয়ার কাউকে ঢুকতে দিলে, তাঁর সামনে খোশমেজাজে কোনো কথা বললে সেটার অন্য অর্থ বের করে প্রকাশ করে দেওয়া হবে। তথ্যচিত্রে সে সুযোগ নেই। এখানে আরও বড় পরিসরে খেলোয়াড়দের নিয়ে কিছু প্রকাশিত হয়, ফলে সেই ভয় থাকে না। কথার অন্য অর্থ বের করা যায় না, ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে।’


সাধারণ মানুষ মনে করেন, এসব তথ্যচিত্র যাঁদের কেন্দ্র করে বানানো হয়, শেষমেশ সেটি কেমন হবে, সে ব্যাপারে তাঁদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। জেরার্ডকে নিয়ে বানানো তথ্যচিত্রের নির্মাতা স্যাম ব্লেয়ার জানিয়েছেন, জেরার্ডের সঙ্গে একটা অনানুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছিল, চলচ্চিত্র বানানো শেষ হলে একদম খুব বেশি আপত্তির জায়গা না থাকলে কিছু পরিবর্তন করা যাবে না। জেরার্ডকে নিয়ে চলচ্চিত্রটা যখন বানানো হলো, কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি যদিও। পরিচালককে জেরার্ড সে স্বাধীনতাটুকু দিয়েছিলেন।

দর্শক এখন আগের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। তাঁরা বুঝতে পারেন, কোন জিনিসটা জোর করে গছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নিজের তথ্যচিত্র নিয়ে আপনি যত বেশি অকপট হবেন, চলচ্চিত্রটা তত বেশি ভালো হবে...
সিমোন অলিভিয়েরা, এজেন্সি কিন

এমনই এক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকা এক ক্রীড়া তারকার কাছের এক মানুষ জানিয়েছেন, ‘তথ্যচিত্রে জীবনের খুঁটিনাটি রাখঢাক ছাড়াই দেখানো হবে, নয়তো চলচ্চিত্র বানানোর কোনো অর্থ থাকবে না।’


২০১৫ সালে রোনালদোকে নিয়ে বানানো এক চলচ্চিত্রের পরিচালক অ্যান্থনি ওঙ্কে জানান, ‘রোনালদোর হাতে সম্পাদনাবিষয়ক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কোনো নির্মাতাই এ রকম শর্তে রাজি হবেন না, এ ভাবে এসব হয় না।’


অলিভিয়েরা জানান, ‘দর্শক এখন আগের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। তাঁরা বুঝতে পারেন, কোন জিনিসটা জোর করে গছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নিজের তথ্যচিত্র নিয়ে আপনি যত বেশি অকপট হবেন, চলচ্চিত্রটা তত বেশি ভালো হবে।’

নেইমার : দ্য পারফেক্ট কেঅস তথ্যচিত্রটি দেখা যাবে নেটফ্লিক্সে
ছবি : টুইটার

ফুটবলাররা তাই তথ্যচিত্রের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা একটু অন্যভাবে করে থাকেন। নির্মাতা কোনো চলচ্চিত্রে হাত দেওয়ার আগে সেই ফুটবলারের সঙ্গে অনেক সময় কাটান, কথাবার্তা বলেন, আস্থার জায়গা অর্জন করেন। ফুটবলারের ব্যক্তিগত জীবনের কত দূর পর্যন্ত যাওয়ার এখতিয়ার আছে তাঁর, সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। এমন কিছু যদি থেকে থাকে, যেটা নিয়ে সেই ফুটবলার কথা বলতে চান না, সেটা কথা বলার মাধ্যমে পরিষ্কার করে নিতে হয়।


নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জনমনে যে ধারণা আছে, তা বদলানোর চেষ্টা থেকে আরেকজন সম্প্রতি নিজেকে নিয়ে তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছেন। তিনি আতলেতিকো মাদ্রিদের ম্যানেজার দিয়েগো সিমিওনে। যে কোচকে নিয়ে আলোচনা হলেই ফুটবল-বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, ইনি সেই মানুষ, সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে কালো পোশাক পরে পাগলামি করাই যাঁর কাজ। এখন মানুষটি যদি আসলেই ওরকম পাগলাটে হন সব সময়, তাহলে ভবিষ্যৎ চাকরিদাতা থেকে শুরু করে পৃষ্ঠপোষক—সবাই তাঁর পেছনে টাকা ঢালার ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগতে পারেন।

আমাজন প্রাইমে প্রকাশিত ‘লিভিং ম্যাচ বাই ম্যাচ’ তথ্যচিত্রে দেখা গেছে, সিমিওনে আসলে ভেতরে-ভেতরে তেমন মানুষ নন। ক্রীড়া মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ ড্যান টুনা সিমিওনে সম্পর্কে বলছেন, ‘তিনি অনেক অকপট। তাঁর পরিবার ও স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি আমরা। পৃথিবীর মানুষের সামনে তাঁর যে একটা পাগলাটে কঠোর ভাবমূর্তি আছে, সেটা নমনীয় করার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এ তথ্যচিত্রের কাজে হাত দিয়েছিলেন।’

* দ্য অ্যাথলেটিক থেকে অনুবাদ : নিশাত আহমেদ


(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)