রোনালদোর কান্নাই ফার্নান্দেজের প্রেরণা

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো থাকার পরও এবারের ইউরোতে পর্তুগালের অন্যতম ভরসার নাম ব্রুনো ফার্নান্দেজ।ফাইল ছবি

পর্তুগালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে মূল ভরসা নিঃসন্দেহে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তবে ইতিহাস রচনায় দলটির মাঝমাঠে বড় ভূমিকা রাখতে হবে ব্রুনো ফার্নান্দেজকেই। পর্তুগালের মাঝমাঠের এই নতুন নেতার প্রেরণা কি জানেন? ১৭ বছর আগে পর্তুগালের ইস্তাদিও দা লুজে রোনালদোর কান্নাই ফার্নান্দেজের বড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠার প্রেরণা।

২০০৪ সালের ৪ জুলাই। নিজেদের মাঠ লিসবনের এস্তাদিও দা লুজে ইউরোর ফাইনালে গ্রিসের কাছে হেরে গিয়েছিল পর্তুগাল। ১-০ গোলের সেই হারের পর হতাশায় শিশুর মতো কেঁদেছিলেন সেই সময়ে ১৯ বছর বয়সী রোনালদো। ব্রুনো ফার্নান্দেজ তখন ৯ বছরের বালক। বাড়িতে বসে টেলিভিশনে খেলা দেখা ফার্নান্দেজকে ছুঁয়ে গেছে রোনালদোর সেই কান্না।

রোনালদোদের বল জোগান দেওয়ার কাজটা করতে হবে মিডফিল্ডার ব্রুনো ফার্নান্দেজকে।
ছবি: রয়টার্স

সেই কান্না ফার্নান্দেজকে অনুপ্রাণিতও করেছিল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিডফিল্ডার ক্লাবের ওয়েবসাইটে সে রকমই বলেছেন, ‘এটা ঠিক যে আপনার একটা ম্যাচ বাজে যেতেই পারে। এমনটা সবার ক্যারিয়ারেই হয়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই বাজে ম্যাচের প্রভাব কাটিয়ে ফিরে আসাটা।’ এ কথাগুলো দিয়ে ফার্নান্দেজ কী বোঝাতে চেয়েছেন সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘ফিরে আসার মানসিকতা হচ্ছে এ রকম—ঠিক আছে, এই ম্যাচটা আমি ভালো খেলতে পারিনি, কিন্তু পরের ম্যাচটায় অবশ্যই ভালো খেলতে হবে। আমার কাছে প্রতিটি দিনই আগের চেয়ে ভালো করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই মানসিকতার কারণে আমি অনেক উন্নতি করছি এবং ওটাই (রোনালদোর কান্না) ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রেরণা।’

১৭ বছর আগে রোনালদোর সেই কান্না এখনো মনে পড়ে ফার্নান্দেজের। আদর্শ রোনালদোকে খুব ভালো করেই অনুসরণ করেন স্পোর্তিংয়ের সাবেক মিডফিল্ডার। ২০০৪ সালের সেই হতাশার পর রোনালদোও অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছেন ফার্নান্দেজও।

পর্তুগালের মাঝমাঠে বড় ভূমিকা রাখতে হবে ফার্নান্দেজকেই।
ছবি: রয়টার্স

ফার্নান্দেজের ফুটবলের পথচলার শুরু পোর্তোর এফসি ইনফেস্তা নামের একটি ক্লাবে। খেলোয়াড়ি জীবনের শুরুটা তিনি করেছিলেন সেন্টারব্যাক হিসেবে। ওই ক্লাবেই মিডফিল্ডারের ভূমিকায়ও খেলতেন ফার্নান্দেজ। কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ম্যাচগুলোতে কোচ তাঁকে খেলাতেন সেন্টারব্যাকে, তুলনামূলক সহজ ম্যাচে তাঁর ভূমিকা থাকত মিডফিল্ডারের।

যে পজিশনেই খেলতেন, মানসিক একটা দৃঢ়তা তাঁর সব সময়ই ছিল। এখনো তাঁর খেলায় সেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছাপটি স্পষ্ট। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা পর্তুগাল দল—যেখানেই খেলুন না কেন, বাকি খেলোয়াড়দের চেয়ে বাড়তি অনুশীলন করেন। কাজ করেন পাসিং আর হেডিং নিয়ে।

সতীর্থদের দিয়ে গোল করানোর পাশাপাশি গোল করায়ও সমান দক্ষ ফার্নান্দেজ।
ছবি: রয়টার্স

কাজের প্রতি নিবেদনের অভাব তাঁর মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের যে পাঁচ ফুটবলার নিয়মিত টেকনিক নিয়ে বাড়তি অনুশীলন করেন, তাঁদের একজন ফার্নান্দেজ। গত মৌসুমে ইউরোপা লিগে এলএএসকের বিপক্ষে একটি ম্যাচে বেঞ্চেই ছিলেন ফার্নান্দেজ। সেই ম্যাচেও সবার শেষে মাঠ ছেড়েছেন। নিজের শুটিং নিয়ে একটু বেশি সময় পর্যন্ত অনুশীলন করেছিলেন তিনি।

কঠিন পরিশ্রম করার এ নেশা ফার্নান্দেজের সেই ছোটবেলা থেকে। বালক বয়সে আরও অনেকের মতো ফার্নান্দেজ রাস্তায় দিনে প্রায় আট ঘণ্টা ফুটবল খেলতেন। ১০ বছর বয়সে বোয়াভিস্তায় চলে যান ফার্নান্দেজ। নিজের মধ্যে বিজয়ীর মানসিকতার বীজ বপন করে দেওয়ার জন্য কৃতিত্ব দেন তাঁর ভাই, চাচাতো ভাই, চাচা আর বাবাকে।

বোয়াভিস্তা ক্লাবে ফার্নান্দেজের পারফরম্যান্স ইতালিয়ান সিরি ‘বি’র দল নোভারার একজন স্কাউটের নজর কাড়ে। বোয়াভিস্তার মূল দলে অভিষেক হওয়ার আগেই ফার্নান্দেজের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলে নোভারা। সেই চুক্তিও আবার ৪০ হাজার ইউরোতে।

পর্তুগালের প্লেমেকার ব্রুনো ফার্নান্দেজ।
ছবি: রয়টার্স

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইতালিতে পাড়ি জমান ফার্নান্দেজ। সেই সময়টা কত কঠিন ছিল তা বোঝাতে পর্তুগালের পত্রিকা ‘রেকর্ড’-এ ফার্নান্দেজ বলেছেন, ‘জুন থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমার কাছে ৫০ ইউরো ছিল। আমি যখন পর্তুগাল ছাড়ি, আমার মা আমাকে এটা দিয়েছিলেন।’ ফার্নান্দেজ এরপর যোগ করেন, ‘নোভারায় পৌঁছে দেখি কাউকে চিনি না, ওখানকার ভাষাটাও জানি না। কথা ভাষান্তর বরার মতোও কেউ ছিল না। সময়টা খুব কঠিন ছিল।’

সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে অন্তর্মুখী ফার্নান্দেজ দ্রুতই নোভার গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। অবনমন এড়ানোর লড়াই করতে থাকা নোভারাকে প্লে-অফ খেলার জায়গায় নিয়ে যান মৌসুমের অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই। এর পুরস্কার হিসেবে ১৯ বছর বয়সে উদিনেসে দলে জায়গা হয় তাঁর। এরপর সাম্পদোরিয়া হয়ে নাম লেখান দেশের ক্লাব স্পোর্তিংয়ে। ক্লাবটিতে তাঁর সাবেক সতীর্থ জেফারসন ফার্নান্দেজকে নিয়ে বলেছেন, ‘প্রথম দেখাতেই মন জয় করে নিয়েছিল সে। নিজের ইচ্ছাশক্তি আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার জন্য খুব দ্রুতই সে জায়গা করে নিয়েছিল। কোচরা সব সময় তাকে মাঠ ছেড়ে বাড়ি যেতে বলতেন। কিন্তু সে বলত, আর একটু, আরেকটু থাকি।’

ইউনাইটেডের পারফরম্যান্সের অনুবাদ ফার্নান্দেজকে এবার পর্তুগালের জার্সিতে করতে হবে।
ছবি: রয়টার্স

অনুশীলনে ফার্নান্দেজ যে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই খুব মনোযোগী ছাত্র ছিলেন তা বোঝাতে গিয়ে স্পোর্তিংয়ের সহকারী কোচ নুনো বলেছেন, ‘অনুশীলনে ব্রুনো সব সময়ই একনিষ্ঠ ছিল। দক্ষতা বাড়াতে সে অনেক বেশি অনুশীলন করত। ব্রুনোর শটগুলো নিখুঁত হতো, ছোট বা বড় পাসেও সে খুব ভালো ছিল। আর বল ছাড়াও প্রতিপক্ষকে খুব ভালোভাবে চাপে রাখতে পারত।’ নুনো এর সঙ্গে যোগ করেন, ‘মাঠে বা মাঠের বাইরে ওর নেতৃত্বগুণ খুব ভালো। অনুশীলন আর খেলার প্রতি তার আবেগটা দুর্দান্ত।’

ম্যাচে সবকিছু ঠিকঠাক না হলে নিজের প্রতি অনেক সময়ই বিরক্ত হয়ে পড়েন ফার্নান্দেজ। তিনি চান সতীর্থরাও সবকিছু গোছানোভাবেই করুক। মাঠে পরিকল্পনামাফিক কোনো কিছু না হলে মাঝেমধ্যে ফার্নান্দেজকে মেজাজও হারাতে দেখা যায়। জেফারসন বলেছেন, ‘সে আমাকে উদ্দেশ করে অনেক চিৎকার করত। এটা স্বাভাবিক ব্যাপারই ছিল। সে হারতে চায় না। সব সময় বল চায়।’

পর্তুগালের মাঝমাঠের নেতা ব্রুনো ফার্নান্দেজ।
ছবি: রয়টার্স

স্পোর্তিংয়ে আড়াই মৌসুমে দুর্দান্ত খেলেছেন ফার্নান্দেজ। ১৩৭ ম্যাচ খেলে গোল ৬৩টি, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ৪৩টি গোল। ইউনাইটেডের স্কাউটদের চোখে পড়ার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। পর্তুগালকে বিদায় জানিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে তিনি ওল্ড ট্রাফোর্ডে বসতি গাড়েন গত বছর। জেফারসন বলেছেন, ‘সে যেভাবে খেলছিল, ইউনাইটেডের তাকে দলে ভেড়ানোটা আমার কাছে মোটেই বিস্ময় হয়ে আসেনি।’

ইউনাইটেডে যে প্রভাব রেখেছেন, তা এককথায় দুর্দান্ত। উলে গুনার সুলশারের দলকে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা পাওয়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ফার্নান্দেজেরই। ফল হিসেবে এরই মধ্যে তাঁকে অনেকেই তুলনা করতে শুরু করেছেন ইউনাইটেডের কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনা আর রোনালদোদের সঙ্গে। ইউনাইটেড কোচ সুলশারের কথা, ‘রোনালদোর মতোই প্রভাব ফেলতে পেরেছে সে। সতীর্থদের সে ঠিক সেভাবেই অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে। সে আসার পর থেকে দলের ফলের দিকে তাকালেই এটা স্পষ্ট হয়।’

এবারের ইউরোতে ব্রুনো ফার্নান্দেজকে এমন উদ্‌যাপনের ভঙ্গিতে বারবার দেখতে চাইবে পর্তুগালের সমর্থকেরা।
ছবি: রয়টার্স

গত বছরের অক্টোবরে ইউনাইটেডের নেতৃত্বও পেয়ে যান তিনি। তবে নেতৃত্ব পাওয়ার পর এমনভাবে কথা বলেছেন যে এটা তাঁর পাওনাই ছিল, ‘(নেতৃত্বগুণটা) আমার মধ্যে সহজাতভাবেই আছে। আমার বলার প্রয়োজন নেই যে আমি একজন নেতা হতে চাই বা আমি ভিন্ন কিছু করব। আমি আসলে এমনই (নেতা)। এটা (নেতৃত্ব) আমার খেলায় এমনিতেই আছে।’

ইউনাইটেডের এ পারফরম্যান্সের অনুবাদ ফার্নান্দেজকে এবার পর্তুগালের জার্সিতে করতে হবে। ফার্নান্দেজ সেটা পারবেন বলেই মনে করেন ইউনাইটেডের সাবেক ডিফেন্ডার রিও ফার্ডিনান্ড, ‘সৃজনশীল খেলা খেলে সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে পর্তুগালের মূল খেলোয়াড় হবে ফার্নান্দেজ। আক্রমণভাগে তাদের খেলোয়াড় আছে—দিয়োগো জোতা, জোয়াও ফেলিক্স ও রোনালদো। তবে বিপজ্জনক এলাকায় বল দিলেই কেবল এরা গোল করতে পারবে।’

সেই বল দেওয়ার কাজটাই ফার্নান্দেজের। এখন দেখার বিষয় সেই কাজটা ইউরোর মঞ্চে কতটা সফলভাবে করতে পারেন তিনি!