লা প্লাতার ওপারের হলেই দুটি বিশ্বকাপ থাকত মেসির

বার্সেলোনার হয়ে যতটা উজ্জ্বল থাকেন লিওনেল মেসি, আর্জেন্টিনার হয়ে ততটা নন।ছবি: রয়টার্স

সাবেক উরুগুয়ে অধিনায়ক দিয়েগো লুগানো জানিয়েছেন তাঁর একটা ধারণার কথা। যাতে স্পষ্ট ছিল উরুগুয়ের না পাওয়ার কষ্ট। কিন্তু এতে আফসোসটা হয়তো আরও বাড়বে লিওনেল মেসির ভক্তদেরও। আক্ষেপের নাম বিশ্বকাপ।

কয়েক বছর আগেও উরুগুয়ের রক্ষণে নিয়মিত নাম লুগানোর ধারণা, মেসি শুধু আর্জেন্টিনার না হয়ে প্রতিবেশী উরুগুয়ের হলেই ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপ জিতে যেত উরুগুয়ে। কী হতো না হতো, তা তো আর নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, তবে লুগানোর ধারণা শুনে দীর্ঘশ্বাস বাড়বে মেসিভক্তদেরও। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের রৌদ্রোজ্জ্বল ক্যারিয়ার বিকেল পেরিয়ে গোধূলির দিকে গড়াচ্ছে, পাল্লা দিয়ে ছায়া বাড়ছে বিশ্বকাপ নামের দীর্ঘশ্বাসের।

লুগানোর কথা মানলে পার্থক্যটা হতো না, মেসি শুধু যদি আর্জেন্টিনা-উরুগুয়েকে আলাদা করে রাখা রিও দে লা প্লাতা নদীর দক্ষিণে না জন্মে উত্তরে জন্মাতেন। তাতে কী হতো? লুগানোর বিশ্লেষণ বলছে, তাহলে উরুগুয়ের এখন বিশ্বকাপ থাকত চারটি, মেসির দুটি।

আর্জেন্টিনার হয়ে লিওনেল মেসির শুধুই হতাশার কাব্য।
ফাইল ছবি

বার্সেলোনার হয়ে সব জেতা মেসির আর্জেন্টিনার জার্সিতে গল্পটা শূন্যতার। কিছুই জেতেননি, বিশ্বকাপ সেখানে সবচেয়ে বড় হতাশা। স্বপ্ন বুকে নিয়ে আকাশি-সাদা জার্সিতে চারবার বিশ্বমঞ্চে দৌড়েছিলেন মেসি। দৌড়ানোই সার। কখনো স্বপ্নটা একটু জ্বলজ্বলে হয়ে সত্যি হওয়ার জোর সম্ভাবনা জাগিয়েছিল, কিন্তু অঙ্কুরেই শেষ।

২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিতে দেখেছেন বেঞ্চে বসে, সে বিশ্বকাপে চোখধাঁধানো ফুটবল খেলা আর্জেন্টিনার কোচ হোসে পেকারমান কী ভেবে যেন কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক জার্মানির বিপক্ষে ১৮ বছরের মেসিকে নামানইনি! উল্টো দল মাত্র ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় মাঝমাঠের প্রাণ হুয়ান রোমান রিকেলমেকেও উঠিয়ে নিয়েছিলেন।

চার বছর পর, দক্ষিণ আফ্রিকা। তারুণ্য ছাপিয়ে মেসি তখন ২২-এর যুবক। বাস্তবতাবোধের ছোঁয়াকে অগ্রাহ্য করা আর্জেন্টিনার জন্য আবেগের নাম হয়ে ডাগআউটে ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামের একজন। মেসি মাঠে, ম্যারাডোনা ডাগআউটে—বিশ্বকাপ ঠেকায় কে! ঠেকাল বাস্তবতা। উছিলা আবারও জার্মানি। মঞ্চ আবারও কোয়ার্টার ফাইনাল। আবেগ দিয়ে এ যুগের ফুটবল যে চলে না, তা বুঝিয়ে দিয়ে জার্মান যন্ত্রে কোয়ার্টারে মেসিরা বিধ্বস্ত ৪-০ গোলে।

আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি।
ফাইল ছবি

মেসির বিশ্বকাপ স্বপ্ন যা একটু সত্যি হওয়ার আশা জেগেছিল এর চার বছর পর। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিবেশী ব্রাজিলের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে দলের নেতা মেসি। দলকে টেনে নিলেন ফাইনালে। কিন্তু মারাকানার ফাইনাল কানা চোখে তাকাল মেসির স্বপ্নের দিকে। আবারও মেসির স্বপ্ন মাড়িয়ে আনন্দে ভাসল জার্মানি।

রাশিয়ার মাটিতে পরের বিশ্বকাপটা অবশ্য মেসির ভুলে যাওয়ার মতোই কেটেছে। দলের রক্ষণ নড়বড়ে, কিন্তু কোচ হয়ে আসা হোর্হে সাম্পাওলি স্বভাবসুলভ হড়বড়ে ঢংয়ে বলে গেলেন, ‘মেসির একটা বিশ্বকাপ প্রাপ্য’, ‘মেসির হাতে ওঠা হবে বিশ্বকাপের সৌভাগ্য।’ বিশ্বকাপটার বুঝি গায়ে লাগল! মেসিদের আবার ‘দল গুছিয়ে আবার এসো’ জানিয়ে বের করে দিল শেষ ষোলো থেকেই! বুঝিয়ে দিল, একজন ম্যাচের কোনো না কোনো একটা মুহূর্তে পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন, কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে একটা দল লাগে।

আর্জেন্টিনার হয়ে একটি বিশ্বকাপ জয়ের আক্ষেপ এখনো কাটেনি লিওনেল মেসির।
ফাইল ছবি

উরুগুয়ের সে দল ছিল। অস্কার তাবারেজের অধীনে রক্ষণে-মাঝমাঠে আঁটসাঁট দলটাতে গোল এনে দেওয়ার জন্য স্ট্রাইকার সব সময়ই ছিলেন, শুধু বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার মতো ‘বিশেষ কিছু’ দেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না! একেবারে ছিল না বললে ভুল হবে, ফোরলান-সুয়ারেজদের খাটো করা হবে। এঁদের পাশে কাভানিও ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তো আর মেসি নন! সৃষ্টিশীলতা, অনন্য কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা, মুহূর্তে সব হিসাব পাল্টে দেওয়া...মেসিদের মতো কেউ কালেভদ্রেই আসেন।

২০১০ বিশ্বকাপটাকে দিয়েগো ফোরলান রাঙিয়ে দিলেন উরুগুয়েকে সেমিফাইনালে তুলে। তাঁর পাশে বিতর্কে-সুন্দরে আলোচিত লুইস সুয়ারেজ ছিলেন। ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানার বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল বাঁচিয়ে দলকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু সেমিফাইনালে তাঁর অভাব বুঝেছে উরুগুয়ে। পরের বিশ্বকাপেও উরুগুয়ে যে শেষ ষোলোতে বাদ পড়ল, তা-ও হয়তো সুয়ারেজের আরেক আলোচিত-সমালোচিত কাণ্ডের কারণে।

আর্জেন্টিনার হয়ে একটি বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখেন লিওনেল মেসি।
ফাইল ছবি

ইতালি, ইংল্যান্ড, উরুগুয়ে—তিন বিশ্বকাপজয়ীর গ্রুপ থেকে শেষ ষোলোতে সহজেই ওঠে উরুগুয়ে, কিন্তু ইতালির বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে জর্জো কিয়েলিনিকে কামড়ে সুয়ারেজ হলেন নিষিদ্ধ। উরুগুয়ে বাদ শেষ ষোলোতে কলম্বিয়ার কাছে হেরে।

দুটি বিশ্বকাপেই দলের রক্ষণের সুর বেঁধে দেওয়া লুগানো ২০১৪ বিশ্বকাপের পরই বুটজোড়া তুলে রেখেছেন। এখন পেছন ফিরে তাঁর মনে হচ্ছে, ‘যদি মেসি ওই ২০১০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের হয়ে খেলত, আমরা বিশ্বকাপ জিতে যেতাম।’ বুয়েনস এইরেসে টিইএ জার্নালিজম স্কুলে এসে ছাত্রদের সঙ্গে আলাপে ২০১৪ বিশ্বকাপের কথাও উঠে এল। তাতেও মেসির সঙ্গে সুয়ারেজের কাল্পনিক যুগলবন্দীতে উরুগুয়ের বিশ্বকাপ জয় দেখছেন লুগানো, ‘যদি মেসি ব্রাজিলে (২০১৪ বিশ্বকাপে) উরুগুয়ের হয়ে খেলত, লুইস সুয়ারেজও নিষিদ্ধ হয়ে বাদ না পড়ত, আমরা ওই বিশ্বকাপও জিতে যেতাম।’

ঝামেলাটা হলো, যদি-কিন্তু দিয়ে শুধু কল্পনাই চলে। সেখানে মেসির অনেক বিশ্বকাপ জয়ের গল্প অনেকের মস্তিষ্কেই রচিত হয়েছে। আরও হবে। বাস্তবতা ‘সত্যিকারের দল হয়ে খেলা’ জার্মানি-ফ্রান্সকেই জেতায় বারবার।