লাল জার্সিধারীদের করুণ গল্প

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ভাড়া করা বাড়ি l প্রথম আলো
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ভাড়া করা বাড়ি l প্রথম আলো

পেশাদার লিগে অপেশাদার ক্লাব

১০ বছর ধরে চলছে বাংলাদেশ পেশাদার ফুটবল লিগ। এখনো যা নামেই পেশাদার। বলতে গেলে ক্লাবগুলোর একটিও পূরণ করেনি পেশাদার ফুটবলের শর্তগুলো। পেশাদার লিগের ১২টি ক্লাবের ভেতর-বাহির নিয়ে নতুন এই ধারাবাহিক

‘ক্যাম্পে একটি টিভি পর্যন্ত নেই। বুঝুন আমরা কেমন আছি।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের এক কর্মকর্তার মুখে হতাশা, দুঃখ, ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার। এই ক্লাবে তিনি খেলেছেন। বড় বাজেটে দল গড়তে দেখেছেন। দলটির জৌলুশ ছিল তখন। আর আজ দিনহীনভাবে দলটার ক্যাম্প চলে। যেখানে সামান্য একটি টিভি থাকে না!

লাল জার্সিধারীদের সমস্যা অগুনতি। খাবারের মান খারাপ। এমনও হয়েছে, খেলার আগের দিন বিকেলে অনুশীলনে নাশতা দই ও চিড়া খেয়েছেন ফুটবলাররা! খাবার টেবিলে ডালভাজি, মুরগির গিলা-কলিজা, আটার রুটি...এসবও খেতে হয়েছে! স্যুপ যা দেয়, ওটা নাকি স্যুপের সংজ্ঞায় পড়ে না। খাবারে টান পড়ে। অনেকে একটু দেরি করে গেলে নাশতা পায় না।

এর আগে ধানমন্ডিতে ক্যাম্প করার সময় খেলোয়াড়দের জন্য দৈনিক খাবারে বরাদ্দ ছিল পাঁচ শ টাকা। এখন সেটি মাত্র ৩০০ টাকা। এই টাকায় এই যুগে কিছুই হয় না খেলোয়াড়দের।

ক্লাব ভবনের অভ্যন্তরে l প্রথম আলো
ক্লাব ভবনের অভ্যন্তরে l প্রথম আলো

আগের কমিটি সাত বছর ছিল। ভালোই দল গড়ত তারা। টাকার তেমন সংকট ছিল না। তবে এবার সংকট চরমে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ক্যাম্পের জন্য নেওয়া পুরো একটা বাড়ির ভাড়া মাসে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ভাড়া ছয় মাস বাকি। ক্লাবের কর্মচারীরা ৪-৫ মাস ধরে বেতনহীন। খেলোয়াড়দের বেতন তিন মাস বকেয়া। তাঁদের বেতনের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা বাকি। বিদেশি খেলোয়াড়দের বেতন নেই দুই মাস।

ম্যানেজার আরিফুল ইসলাম চরম হতাশা নিয়ে বলেন, ‘৫-৬ লাখ টাকা বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারকর্জ করে দলটা চালিয়ে এনেছি। কী বলব, আমার বেতনও নেই চার মাস। কোচ কায়সার ভাইসহ আরও কয়েকজন সমর্থন দিয়েছেন বলে ক্যাম্প চলেছে। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাম্পের খাবারের জন্য এক টাকাও পাইনি আমরা।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নিজস্ব ভবন আছে ইস্কাটনে। তবে সংসদের অধীনে পরিচালিত ক্রীড়াচক্রের খেলোয়াড়দের থাকার জায়গা নেই, কখনোই ছিল না। এ মৌসুমে বসুন্ধরায় ক্যাম্প আসার পরই কালো মেঘ জমে আকাশে। কাল থেকে তিন সপ্তাহের জন্য লিগ বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তাই ‘আল্লাহর রহমত’ বলছেন দলের এক সদস্য। ক্যাম্প চলবে না। খেলোয়াড়দের দুর্ভোগ থাকবে না। এটাই আপাতস্বস্তি।

মুক্তিযোদ্ধার মাঠ নেই। আগে উত্তরা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের মাঠ, সামরিক জাদুঘর মাঠ ব্যবহার করত। এবার বসুন্ধরায় তিন শ ফুট রাস্তার পাশে কাঞ্চন ব্রিজ নামের কলেজ মাঠ ভাড়া নেওয়া হয়েছে। যদিও পুরো মৌসুমের জন্য পাওয়া যায়নি। বৃষ্টি হলে মাঠ ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। তবে তেলের অভাবে অনুশীলন মাঠেও ঠিকমতো গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না!

অথচ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় এক অর্থে এটি সরকারি ক্লাব। চাইলে সরকারের উদ্যোগে আবাসন এবং অনুশীলন মাঠের স্থায়ী ব্যবস্থা হতেই পারত। দুঃখজনক যে এত বছরেও কিছুই হলো না।

একঝাঁক নবীন খেলোয়াড় নিয়ে এবার দলটাও হয়েছে জোড়াতালির। রক্ষণে বিদেশি আব্বাস ছাড়া নির্ভর করার মতো কেউ নেই। এই দলের লিগে আট ম্যাচ খেলে দুটি জয় পাওয়াও অনেক। গত পাঁচটি ম্যাচ টানা হেরে যাওয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।

২০০৮ সালেও সংকটে পড়ে টানা আট ম্যাচ হারের তেতো অভিজ্ঞতা আছে দলটির। এবারের সংকট কাটাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে ম্যানেজারসহ আরও কয়েকজন দুই দিন আগে যান। তিনি নাকি বলে দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। কারণ আদালতে মামলা ঝুলছে। ঈদের পর বকেয়া মেটাতে মন্ত্রী ৮ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মামলার জেরে প্রক্রিয়াটা এগোয়নি।

সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেন। সংসদের নতুন কমিটি না আসা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী দলের পাশে দাঁড়ান। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দুই দিন খেলা দেখতে এসে বলেন, ‘সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’ দুই দিনই দল জেতে। কিন্তু অবৈধঘোষিত বিদায়ী কমিটি আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসায় জটিলতা বেড়েছে। অভিভাবকহীন খেলোয়াড়-স্টাফ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার কথাও ভাবছেন।

কর্মকর্তা-খেলোয়াড়েরা বলছেন, গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভবনে জুয়ার বোর্ড থেকে প্রতিদিন নাকি দেড় লাখ টাকা আসে। ওই তহবিল থেকেই ক্লাবের ফুটবল দল পরিচালিত হয়। সমস্যা তেমন থাকে না। তবে এবার আদালতের রায়ে সংসদের আগের কমিটি বাতিল হওয়ার সময় ক্রীড়াচক্রের তহবিলে নাকি মাত্র ৪০ হাজার টাকা ছিল।

প্রধান কোচ মাসুদ কায়সার পারভেজ সবকিছু দেখে হতাশ, ‘এভাবে ভালো কাজ করা অসম্ভব। সারাক্ষণ মাঠের বাইরের বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে চলে না।’ দলটির সহকারী কোচ সাবেক জাতীয় ফুটবলার দস্তগীর হোসেন নীরা। গোলরক্ষক কোচ মোহাম্মদ পনির।

চুরানব্বইয়ে আবাহনী-মোহামেডান ভেঙে প্রথম বড় দল গড়ে মুক্তিযোদ্ধা সাড়া ফেলেছিল দারুণভাবে। কিন্তু সেই ‘বড় দল’ এখন আর নেই। মাঝে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। অনেকটা বুদ্‌বুদের মতো। এবার তো আশঙ্কা হচ্ছে একেবারেই না নিঃশেষ হয়ে যায়!

দুবার রানার্সআপ

১০টি পেশাদার লিগেই টিকে আছে মুক্তিযোদ্ধা। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও চতুর্থ ও পঞ্চম লিগে রানার্সআপ হওয়াও কম নয়। গতবার ছিল পঞ্চম। প্রথম তিন লিগে তৃতীয়, দশম, ষষ্ঠ। ষষ্ঠ ও সপ্তম লিগে যথাক্রমে ষষ্ঠ ও তৃতীয়।

 পেশাদার লিগে এখন পর্যন্ত ১৯৯ ম্যাচ খেলে জয় ৮৫। ড্র ৪৪, হার ৬৬। গোল ২৯৮, বিপক্ষে ২৩০।