লিভারপুলকে ঠেকাতে আদর্শে দাগ লাগাতেও রাজি আর্সেনাল

গত মাসে কমিউনিটি শিল্ডে লিভারপুলকে রুখে দিয়ে শিরোপা জিতেছে আর্সেনাল।ছবি: রয়টার্স

অ্যানফিল্ডে না হয়ে ম্যাচটা নিজেদের মাঠে হলে হয়তো আর্সেনাল কোচ মিকেল আর্তেতার উদ্বেগ কম থাকত! গত দুই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের পর প্রিমিয়ার লিগও জেতা লিভারপুল প্রায় সব মাঠেই এখন ভয়ংকর, কিন্তু ইয়ুর্গেন ক্লপের দলটার বিপক্ষে অ্যানফিল্ডের চেয়ে নিজেদের মাঠেই যে আর্সেনালের রেকর্ড তুলনামূলক ভালো। আর অ্যানফিল্ডে? ক্লপ লিভারপুলে আসার পর থেকে সেখানে প্রতিটি ম্যাচে রীতিমতো গোলের বান সইতে হয়েছে আর্সেনালকে!

রেকর্ডটাই দেখুন! ক্লপ আসার পর এ পর্যন্ত অ্যানফিল্ডে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ছয়টি ম্যাচ খেলেছে আর্সেনাল। জেতার তো সুযোগই হয়নি, ড্র-ই হয়েছে শুধু একটি ম্যাচে। ছয় ম্যাচে লিভারপুল গোল করেছে ২৩টি, কোনো ম্যাচে তিনটির কম নয়! গোলের এই বান ঠেকানো তো সহজ কাজ নয়, মিকেল আর্তেতার অধীনে অনেকটাই গুছিয়ে ওঠা আর্সেনালও সেই কঠিন কাজের প্রস্তুতিই নিচ্ছে। আর্তেতা তো বলেই দিয়েছেন, লিভারপুলকে ঠেকাতে প্রয়োজনে নিজের ফুটবল আদর্শ বদলাতেও রাজি তিনি!

আর্তেতার সঙ্গে অবামেয়াং—ডাগআউট আর মাঠের এই জুটিতেই স্বপ্ন দেখে আর্সেনাল।
ছবি: রয়টার্স

২০১৫ সালের অক্টোবরে লিভারপুলে আসেন ক্লপ, সেই মৌসুমে জানুয়ারিতে অ্যানফিল্ডে আর্সেন ওয়েঙ্গারের আর্সেনালের সঙ্গে রোমাঞ্চ ছড়ানো লিগ ম্যাচটা ড্র হয়েছে ৩-৩ গোলে। তারপর থেকে বড় হারই সঙ্গী, লিগে পরের চার সাক্ষাতে অ্যানফিল্ডে লিভারপুল জিতল ৩-১, ৪-০, ৫-১ ও ৩-১ ব্যবধানে। আর সর্বশেষ ম্যাচটি তো আর্সেনালের জন্য একটু বিব্রতকরই। লিগ কাপ ও এফএ কাপে ক্লপ সব সময়ই দ্বিতীয় সারির দল নামান, গত অক্টোবরে লিগ কাপে আর্সেনালের বিপক্ষেও তা-ই করেছিলেন। কিন্তু কচিকাঁচাদের নিয়ে গড়া সেই লিভারপুলের বিপক্ষেও উনাই এমেরির আর্সেনাল ড্র করল ৫-৫ গোলে, পরে টাইব্রেকারে হেরেই গেল!

মিকেল আর্তেতা অবশ্য বলতে পারেন, আর্সেনালের ওই দলগুলো তো তাঁর অধীনে ছিল না! এক সময়ে আর্সেনালে খেলা স্প্যানিশ মিডফিল্ডার কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেছেন ম্যানচেস্টার সিটিতে পেপ গার্দিওলার সহকারী হয়ে, তিন বছর সেখানে দারুণ কাজই দেখিয়েছেন। গত ডিসেম্বরে এসেছেন আর্সেনালের ডাগআউটে, মূল কোচ হয়ে। আসার পর থেকে আর্সেনালের খেলায় বদলটা স্পষ্ট। আর্সেনাল তো সব সময়ই গতিময় পাসিং ফুটবল খেলে, আর্তেতার অধীনে সেটি বদলানোর কোনো কারণ নেই।

লিগে এরই মধ্যে একটা হ্যাটট্রিক হয়ে গেছে সালাহর।
ছবি: রয়টার্স

তবে আর্তেতা যা করেছেন, তা হলো, আর্সেনালের ‘স্বভাবসুলভ’ নরম-সরম ভাব দলটা থেকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন। বছর কয়েক আগেও দাপুটে চেলসি-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো দলের বিপক্ষে ম্যাচগুলোতে ম্রিয়মান হয়ে পড়া আর্সেনাল এখন দৃশ্যত কাউকে ডরায় না, ছেড়েও কথা কয় না।

আর্তেতার অধীনে লিভারপুলের বিপক্ষে যে দুটি ম্যাচ খেলেছে আর্সেনাল, সেটিও ‘গানারদের’ বদলে যাওয়ার গানই শোনায়। জুলাইয়ে লিগে নিজেদের মাঠে লিভারপুলকে ২-১ গোলে হারিয়েছে আর্সেনাল, ২০১৫ সালের এপ্রিলের পর সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ১১তম ম্যাচে এসে যা ছিল লিভারপুলের বিপক্ষে আর্সেনালের প্রথম জয়। এরপর গত আগস্টে কমিউনিটি শিল্ডেও লিভারপুলের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করার পর টাইব্রেকারে জিতে শিরোপা উৎসবে মেতেছে আর্সেনাল। আর লিভারপুলকে একপাশে রেখে প্রসঙ্গ যদি হয় শিরোপা, গত আগস্টে চেলসিকে ২-১ গোলে হারিয়ে এফএ কাপ জিতেছে আর্সেনাল।

ফিরে আসা যাক লিভারপুল-আর্সেনাল প্রসঙ্গে, আর্তেতার অধীনে দুই ম্যাচেই লিভারপুলকে হারানোর পথে আর্সেনালের খেলার দর্শন কিন্তু আর্সেনালের মতো ছিল না। দুই জয়ের পথে ম্যাচে আর্সেনালের বলের দখল ছিল যথাক্রমে ৩১ ও ৪১ শতাংশ। বলের দখল চুলোয় যাক, পাসিং ফুটবলের আদর্শে দাগ লাগে লাগুক, সালাহ-মানে-ফিরমিনোদের আটকে রেখে অবামেয়াং-সাকাদের গতি কাজে লাগিয়ে পাল্টা আক্রমণকেই কৌশল মেনেছেন আর্তেতা। আর সাফল্য যখন এসেছে, তাহলে আর প্রশ্ন তোলারও কিছু থাকে না!

এই মৌসুমে চেলসি থেকে উইলিয়ানকেও নিয়ে এসেছে আর্সেনাল, ফুটবলে ট্রানজিশন বা রক্ষণ থেকে দ্রুত আক্রমণে ওঠার কৌশল যাঁর ভালোই জানা। অবামেয়াংয়ের গতি, আর গোলের সামনে লাকাজেতের দুর্দান্ত ফর্ম মিলিয়ে এই কৌশলে আজও দেখা যেতে পারে আর্সেনালকে। আর্তেতা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন, ‘মাঝে মধ্যে ব্যাপারটা দাঁড়ায় আপনি কোচ হিসেবে কী করতে চাইছেন, আর মাঝে মধ্যে বড় প্রতিপক্ষ আপনাকে কতটুকু কী করার সুযোগ দেয় সেদিকে মনোযোগ দিতে হয়। (লিভারপুলের বিপক্ষে ওই দুই ম্যাচে) সবাই দেখেছে ম্যাচের অনেকটা সময় আমরা নিজেদের অর্ধে থেকে রক্ষণকাজ চালিয়ে গেছি। কিন্তু মূল ব্যাপার হচ্ছে আমাদের জেতার মতো পরিস্থিতি খুঁজতে হবে।’

জয়ই তাঁর কাছে শেষ কথা জানিয়ে আর্তেতা বললেন, ‘আমি এখানে জিততে এসেছি। জয়ের জন্য যে উপায় দরকার, সেটি খুঁজে বের করা আমার কাজ। আমি অনন্য কোনো কৌশল বের করলাম, কিন্তু সেটি আমার দলের দুর্বলতাই প্রতিপক্ষের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়, তাহলে তো আমি ক্লাবের বা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ঠিক করলাম না। আমাদের তেমন খেলোয়াড় আছে যাদের নিয়ে চাইলেই কৌশল বদলে খেলানো যায়। এখনকার ফুটবলে আপনি সব সময় প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী না হলে একই কৌশল দিয়ে পার পাবেন না।’

লিগে এবার দুই দলের শুরুই দারুণ হয়েছে। দুটি করে ম্যাচ খেলেছে, দুটিতেই জিতেছে। ফুলহামকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার পর আর্সেনাল নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ২-১ গোলে হারিয়েছে ওয়েস্ট হামকে। লিভারপুল প্রথম ম্যাচে লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে জয়ের পথে ভুগেছে, তবে দ্বিতীয় ম্যাচে চেলসিকে দারুণ দাপটে হারিয়েছে ২-০ গোলে। আজ কোনো এক দলের জয়রথ থামবে, নাকি দুদলেরই জয়রথ থামিয়ে দেওয়া ড্র দেখবে অ্যানফিল্ড?

ম্যাচের আগে অবশ্য বেশি দুশ্চিন্তায় লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। মূল গোলকিপার আলিসন আর কদিন আগেই বায়ার্ন মিউনিখ থেকে আসা মিডফিল্ডার থিয়াগো আলকানতারার ফিটনেস নিয়ে সংশয় আছে। ম্যাচের আগে ফিটনেস টেস্ট হওয়ার কথা দুজনের। সেটিতে দুজন উতরে গেছেন কি না, এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। লিভারপুল অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন, ডিফেন্ডার জোয়েল মাতিপ চোটে। সংশয় আছে আরেক ডিফেন্ডার জো গোমেজকে নিয়েও।