লিভারপুলের ছকেই লিভারপুলকে ঘায়েল

দিনটা সালাহদের ছিল না।ছবি: এএফপি

ডিন স্মিথ কী ইয়ুর্গেন ক্লপের অনুরাগী? স্মিথ নিজে এ কথা কখনো বলেননি। তবে গত রাতে লিভারপুলের বিপক্ষে অ্যাস্টন ভিলাকে যেভাবে খেলালেন তিনি, দেখে অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগতে পারে। তার ওপর এই ম্যাচে লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা পরেছিলেন ঐতিহ্যবাহী লাল জার্সির বদলে কালো জার্সি। ফলে যদি কারও মনে প্রশ্ন জেগে থাকে, ‘লিভারপুল কোনটি, বেগুনিরঙা জার্সির দলটা নয়তো?’—তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।  

আর এখানেই অ্যাস্টন ভিলার কোচ ডিন স্মিথের সাফল্য। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, গত দুই মৌসুম ধরে লিভারপুল যেভাবে ছুটছে, সেটা থামাতে লিভারপুলের কৌশলটাই নকল করতে হবে। এর বিকল্প নেই কোনো। তবে এ জন্য ওয়াটফোর্ডের সাবেক কোচ নাইজেল পিয়ারসনেরও একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। গত মৌসুমের শেষ দিকে লিভারপুলের ফর্ম যখন দুরন্ত, প্রতিপক্ষ কোচেরা যখন ক্লপের দলের বিপক্ষে মাত্র এক পয়েন্ট পাওয়ার জন্য হন্য হয়ে উপায় খুঁজছেন, তখনই একটা দারুণ ব্যাপার দেখিয়েছিলেন পিয়ারসন।

ওয়াটফোর্ড দেখিয়েছিল, ‘হাই লাইন ডিফেন্স’ ধরে রেখে খেলা লিভারপুলের ডিফেন্ডারদের পেছনের ফাঁকা জায়গাটা যদি দ্রুতগতির প্রতি আক্রমণে ব্যবহার করা যায়, লিভারপুলের মতোই নিরন্তর প্রেস করা যায় ওসব ফাঁকা জায়গায়, সাফল্য আসার সম্ভাবনা আছে। ওই ম্যাচে ওয়াটফোর্ড জিতেছিল ৩-০ গোলে। পরে পিয়ারসনের দল অবনমিত হয়ে গেলেও, ক্লপের দলের কাছ থেকে পয়েন্ট ছিনিয়ে নেওয়ার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল অন্য কোচদের সামনে।

৩০ বছর পর লিগ শিরোপা জেতার অতি আনন্দে হোক বা মনোযোগের ঘাটতির কারণে অথবা টানা খেলার ধকলে, লিভারপুল ডিফেন্ডারদের ফর্ম কিছুটা পড়তির দিকে এই মৌসুমে। ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড আক্রমণে যেমন পটু, রক্ষণে তেমন নন। এই সমস্যা তাঁর মধ্যে আগেই অল্পবিস্তর থাকলেও এ মৌসুমে যেন আরও প্রকট হয়েছে। নিয়মিত সঙ্গীর অভাবে ভার্জিল ফন ডাইকও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেন না। চোট থেকে ফেরা জো গোমেজ আছেন নিজের ছায়া হয়ে। এই মৌসুম শুরু হওয়ার পর প্রতিপক্ষ কোচেরা ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। ওদিকে পিয়ারসনের দেখানো সাফল্যের সূত্র তো হাতের কাছে ছিলই।

একাই লিভারপুলের মিডফিল্ডকে চরকির মতো ঘুরিয়েছেন অ্যাস্টন ভিলার অধিনায়ক জ্যাক গ্রিলিশ।
ছবি: এএফপি

ব্যস, একইভাবে দলকে খেলালেন লিভারপুলের প্রথম তিন ম্যাচের প্রতিপক্ষ কোচেরাও। প্রতিটি ম্যাচেই জেতার বা ড্র করার ভালো সম্ভাবনা তৈরি করেছিল প্রতিপক্ষ দল। এবার লিগে লিভারপুলের প্রথম প্রতিপক্ষ লিডস ইউনাইটেডের কথাই ধরুন। দুর্দান্ত প্রতি আক্রমণনির্ভর দল লিডস, খেলেও চোখধাঁধানো ফুটবল। খেলোয়াড়দের মধ্যে রসায়নও দারুণ। কিংবদন্তি কোচ মার্সেলো বিয়েলসা পিয়ারসনের কাছ থেকে সেই টোটকা নিয়ে নিজের কিছু পরিকল্পনা মেশালেন। ফলাফল? আরেকটু হলে জিতেই যাচ্ছিল লিডস। ওপরে উঠে আসা লিভারপুলের রক্ষণকে বারবার শাস্তি দিয়েছে লিডস, বাজে ফর্মে থাকা ডিফেন্ডারদের বাধ্য করেছে ভুল করার জন্য। শেষ মুহূর্তে মোহাম্মদ সালাহ গোল না করলে ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়ত লিডস।

কিংবা চেলসির বিপক্ষে ম্যাচটার কথাই ধরুন। ‘হাই লাইন-এ উঠে যাওয়া ডিফেন্ডারদের সঙ্গে গোলরক্ষকের মধ্যকার ফাঁক কাজে লাগাতে দ্রুত প্রেস করতে হবে—পিয়ারসনের এই সূত্রের সঙ্গে চেলসির কোচ ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড নিজের তত্ত্বও কিছুটা যোগ করলেন। বল পায়ে আক্রমণের সময়ে লিভারপুল যা যা করে, কিংবা বল পায়ে না থাকলে লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা যেভাবে প্রতিপক্ষকে ঘিরে ধরে, ঠিক একই কাজ শিষ্যদের করতে বলেছিলেন ল্যাম্পার্ড। ফল হয়তো পেয়েও যেতেন, যদি না প্রথমার্ধের শেষ দিকে আন্দ্রেয়া ক্রিস্টিয়ানসেন লাল কার্ড খেয়ে দলকে বিপদে না ফেলতেন।

তৃতীয় ম্যাচে আরতেতার আর্সেনালও একই কাজ করল। সে ম্যাচে আবার আর্সেনালের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একদম নিচ থেকে খেলার প্রবণতা। লিভারপুলের হাই লাইন ডিফেন্সকে শাস্তি দেওয়ার জন্য লাকাজেত-অবামেয়াংরা উঠে গেলেও, দিন শেষে নিজেদের ওই প্রবণতার কারণে ম্যাচ হারতে হয়েছিল গানারদের।

হ্যাটট্রিক পেয়েছেন ওয়াটকিন্স।
ছবি: এএফপি

গত রাতে ডিন স্মিথ তাঁর দলকে নিয়ে তেমন কিছুই করতে দেননি। লিভারপুলকে আটকানোর জন্য নিজেদের খেলার ধরনের সঙ্গে ল্যাম্পার্ড বা আরতেতার মতো বাড়তি কোনো উপকরণ যোগ করতে যাননি। লিভারপুল ডিফেন্ডারদের ফর্ম নেই তেমন, ডিফেন্ডাররা ছাড়া মিডফিল্ড ও আক্রমণভাগে যে দুজন সবচেয়ে বেশি প্রেস করেন লিভারপুলের হয়ে, সেই জর্ডান হেন্ডারসন ও সাদিও মানে-ও নেই। সুতরাং তাঁদের নিরন্তর প্রেস করে যাও। শুধু তা-ই নয়, লিভারপুল যেমন বল হারানোর সঙ্গে সঙ্গে যে প্রতিপক্ষের পায়ে বল কয়েকজন মিলে তাঁকে ঘিরে ধরে বল কেড়ে নেয়, সেভাবে তাদের পা থেকেও বল কেড়ে নাও। ফাঁকা জায়গাগুলোতে পাস দেওয়ার পথ গুলো বন্ধ করে দাও, প্রেস করে চলো অবিরাম। সঙ্গে ওপরে থাকা ডিফেন্ডারদের পেছনে থাকা জায়গার সদ্ব্যবহার করো গতি দিয়ে।

ঐতিহাসিক এই স্কোরলাইন।
ছবি: এএফপি

গোটা নব্বই মিনিট স্মিথের শিষ্যরা এটাই করে গেলেন। সঙ্গে ভিলার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলো লিভারপুলের মূল গোলরক্ষক আলিসনের চোট। বিকল্প হিসেবে নামা আদ্রিয়ান যখনই খেলেন, কিছু না কিছু ভুল করেনই। চেলসির বিপক্ষে গত মৌসুমে এফএ কাপের ম্যাচ, কিংবা আতলেতিকোর বিপক্ষে হেরে যে ম্যাচে লিভারপুল চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায় নিল, সেসব ম্যাচে আলিসনের অভাব ছিল স্পষ্ট। আদ্রিয়ানের ভুলেই গত রাতে প্রথম গোল খায় লিভারপুল। সেই যে শুরু, বাকি সময়টা শুধু অ্যাস্টন ভিলার খেলাই চেয়ে চেয়ে দেখেছে লিভারপুল।

এই ম্যাচটা আবারও প্রমাণ করে দিল, ‘হাই লাইন ডিফেন্স’ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান জলদি না করতে পারলে লিভারপুলের এমন দশা হতে পারে এই মৌসুমে আরও।