শতবর্ষী ভিক্টোরিয়ায় এখন ঘোর অন্ধকার

ছবিটি ক্যাসিনো–কাণ্ডে কলঙ্কিত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব তাঁবুর। শতবর্ষী এই ক্লাব এক সময় ছিল দেশের খেলাধুলার অন্যতম শক্তি। ফুটবল, ক্রিকেট লিগে অতীতে শিরোপাজয়ী এই ক্লাবের অধোগতি হয়েছিল আরও আগেই। চূড়ান্ত অধঃপতন ঘটেছে জুয়া–ক্যাসিনো দিয়ে। এক সময়ের আলো ঝলমলে এই ক্লাবে এখন ঘোর অন্ধকার।ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের ফটকে ঝুলতে থাকা তালায় ধুলোর আস্তরণ জমেছে। কর্মকর্তা-খেলোয়াড়দের ক্লাবে আসা-যাওয়া বন্ধ। চিরচেনা সেই আড্ডা নেই। ভিক্টোরিয়া ক্লাব ভবন যেন ঘোর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

এই এক বছর অন্য তালাবন্ধ ক্লাবগুলোর যেমন কেটেছে, ব্যতিক্রম নয় ভিক্টোরিয়াও। করোনায় সব খেলা বন্ধ মার্চ থেকে। দমবন্ধ এক সময় চলছে মতিঝিল-আরামবাগ ক্লাব পাড়ায়। তবে অন্য ক্লাবের চেয়ে ভিক্টোরিয়ার কষ্টটা বেশি। ক্যাসিনো-কাণ্ডে বন্ধ হয়ে যাওয়া ছয় ক্লাবের মধ্যে ইতিহাস-ঐতিহ্যে অনেক এগিয়ে ভিক্টোরিয়া। ক্লাবটির শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে সেই ২০০৩ সালে।

এমন ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে ক্যাসিনো এল কীভাবে? প্রশ্নটা এখনো বেদনাহত করে ফুটবলপ্রেমীদের। ভিক্টোরিয়ার সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সবকিছু একটা জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ হতো। কিছু করার ছিল না আমাদের।’ ভিক্টোরিয়ায় ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট। তবে ক্যাসিনো হোতাদের নাম মুখে নিতেও যেন মানা ভিক্টোরিয়ার কর্মকর্তাদের! অন্য ক্লাবের কর্মকর্তারাও সন্তর্পণে এড়িয়ে চলেন নামগুলো। কিন্তু ক্লাবে যখন ক্যাসিনো ঢোকে, ভিক্টোরিয়ার পরিচালনা কমিটি কী করল? ক্যাসিনো প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই হয়নি, উল্টো অনেকে ক্যাসিনো থেকে লাভবান হয়েছেন।

ভিক্টোরিয়ার মতো একটি ক্লাবের পতন, ক্যাসিনো চালু-এসব নিয়ে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘ক্যাসিনোর ব্যাপারটি ঝড়ের বেগে এসেছে, আবার ঝড়ের বেগে চলে গেছে। আমরা ক্লাব কর্মকর্তারা এসবের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।’ ক্যাসিনো থেকে ভিক্টোরিয়া কতটা আর্থিক লাভবান হলো, সেই টাকাইবা গেল কোথায়, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ভিক্টোরিয়ার সাধারণ সম্পাদকের ভাষ্য, ক্লাবটির তহবিলে নাকি এখন মাত্র ৫০-৫৫ হাজার টাকা আছে।

‘ক্লাবের কোনো লাভ হয়নি। ক্লাবকে ওইভাবে কোনো টাকা দেয়নি ওরা’-দাবি মাজহারুল ইসলামের। তাহলে সব লাভ সম্রাটেরা নিয়ে গেছেন? সাধারণ সম্পাদকের উত্তর, ‘নির্দিষ্ট কোনো টাকার অঙ্ক নেই। হয়তো দলবদল হচ্ছে, একটা প্লেয়ারকে তারা টাকা দিল।’ অথচ ক্যাসিনো থেকে ক্লাবগুলো দৈনিক হারে ভাড়া পেত বলেই জানা যায়।

সম্রাটেরা জোর করে ক্লাবে ক্যাসিনো বসায়, বলেন ভিক্টোরিয়ার সভাপতি নেসার আহমেদ। ক্লাব কর্মকর্তারা ভয়ে কিছু বলেননি, এই অভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে সব ক্লাব থেকেই। ক্যাসিনো বসাতে না দিয়ে উপায় ছিল না, প্রাণের ভয় সবারই আছে-এ-জাতীয় বক্তব্যই দিচ্ছেন ক্লাব কর্মকর্তারা। ক্লাবের অনুমতির অপেক্ষাও নাকি করেনি ক্যাসিনোর হোতারা। নিজেরাই দখল নিয়েছে ক্লাবের।

কর্মকর্তারাই যা-ই বলুন, ক্যাসিনো ভাড়ার টাকা ক্লাবে ক্লাবে লুটপাটের অনেক অভিযোগ আছে। ভিক্টোরিয়ার কী অবস্থা, জানতে চাইলে ক্লাবটির সভাপতি বলেন, ‘ওইভাবে ওরা ক্লাবকে কিছু দিত না। তবে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি যেহেতু ব্যবহার করত, কিছু টাকা দিত। সেটাও তাদের খুশিমতো। দৈনিক কখনো ৫ হাজার, কখনো ১০ হাজার, কখনো ২০ হাজার।’ সভাপতি বলেছেন নিজেদের অসহায়ত্বের কথাও, ‘আমরা অসহায় ছিলাম। জীবনের ভয় তো সবারই আছে।’ ক্লাবটির যুগ্ম সম্পাদক (ক্রীড়া) এ টি এম নুরুজ্জামানের ভাষায়, ‘যেকোনোভাবেই হোক, ক্লাব ক্যাসিনো ঠেকাতে পারেনি। কিছু করার ছিল না আমাদের।’

খেলায় অবনমন গত ২০ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগে তৃতীয় হয়েছে ভিক্টোরিয়া। ক্লাব বন্ধ থাকায় খেলোয়াড়দের রাখা হয় কমলাপুর ও বক্সিং স্টেডিয়ামে। ঢাকার শীর্ষ ক্রিকেট লিগে চারবারের চ্যাম্পিয়ন এই ক্লাবের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চরম অবনমন হয়েছে ক্রিকেট মাঠে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রিমিয়ার ক্রিকেটে খেলা ভিক্টোরিয়া ২০১৮ সালে নেমে যায় প্রথম বিভাগে। এ বছর খেলল দ্বিতীয় বিভাগে। তবে হকিতে সর্বশেষ মৌসুমে খেলেছে প্রিমিয়ারে। হ্যান্ডবলেও তারা প্রিমিয়ারের দল। বক্সিং, রাগবিও খেলে ক্লাবটি। তবে ফুটবলে প্রিমিয়ার থেকে নেমে গেছে অনেক আগেই। পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে তারা খেলছে এই লিগের শুরু থেকেই (২০১১)। এ বছর মে মাসে করোনাভাইরাসের কারণে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ বাতিল হয়ে যায়। ফুটবলে ১৯৬২ সালে ঢাকা লিগসহ চার-পাঁচটি ট্রফি জয় ক্লাবটির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। ভিক্টোরিয়ার অতীত আলোকিত হলেও বর্তমান অন্ধকারে ঢাকা।

আর এভাবেই ১১৭ বছরের পুরোনো ক্লাব ভিক্টোরিয়ার সম্মান ধুলোয় লুটিয়েছে। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুজনই ক্লাবটির সাবেক ফুটবলার। অনেক পেছন থেকে উঠে এসে ক্লাবের শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন। তাঁদের চোখের সামনে কেউ ক্লাবে জোর করে ক্যাসিনো বসিয়েছে, আর তা থেকে ক্লাবের তেমন কোনো আয় হয়নি, এটা অবিশ্বাস্যই। খিলগাঁও এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার নেসার উদ্দিন ২০১৫ সাল থেকে ভিক্টোরিয়ার সভাপতি। নেসারের বাবা এই ক্লাবের সহসভাপতি ছিলেন, তাঁর খালু ছিলেন সভাপতি। ক্লাবটির সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক সম্পর্ক। চার বছর ধরে সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম ১২ নম্বর গুলবাগ-শান্তিবাগ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অথচ তাঁরা বলছেন, তাঁদের নাকি কিছুই করার ছিল না!

১৩ মাস ধরে এই কর্মকর্তারা ক্লাবে যেতে পারেন না। বন্ধ ক্লাবের অনেক কিছু নাকি চুরিও হয়ে গেছে। নেতৃত্বের জন্য এটা লজ্জার নয় কি? ‘নিজেকে ভিক্টারিয়ার কর্মকর্তা পরিচয় দিতে এখন লজ্জাই লাগে’-হতাশ কণ্ঠে বলেন ভিক্টোরিয়ার সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু তাতে ভিক্টোরিয়ার ঐতিহ্যে লাগা ক্যাসিনোর কালি মুছবে না কখনো। কলঙ্কের সাক্ষী হয়ে থাকবে মোহামেডানের পাশেই আট কাঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত একতলা টিনশেড ক্লাব ভবনটি।

ভিক্টোরিয়া অনেক আগে থেকেই নানা সংকটে ধুকছিল। ক্যাসিনো-কান্ড আরও ডুবিয়েছে ক্লাবটিকে। গত ৩০ এপ্রিল ক্লাবের বর্তমান পরিচালনা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মে মাসে মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়। নভেম্বরের সাধারণ সভা ডেকে নতুন কমিটি গঠন হবে।

কিন্তু ভিক্টোরিয়ার সেই সম্মান আর গৌরব কি ফিরে আসবে তাতে? যাঁর নামে ক্লাব, সেই রানি ভিক্টোরিয়া নিশ্চয়ই অনন্তলোকে কষ্ট পাচ্ছেন শুধু।