শাখতার–রূপকথায় রিয়ালের হার

প্রথমার্ধে রিয়ালের বাজে রক্ষণের সুযোগ নিয়ে এগিয়ে যায় শাখতার।ছবি: রয়টার্স

রূপকথা? তা বলাই যায়। লজ্জা? তাতেও অত্যুক্তি হয় না। শাখতার দোনেৎস্কের জন্য কাল রাতটা রূপকথার হলে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য তা নত মাথায় মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসা। স্রেফ অবিশ্বাস্য হার!

ইউক্রেনিয়ান ক্লাবটির কোচ লুইস কাস্ত্রোর ম্যাচের আগেই ঘুম ছুটে গিয়েছিল। ক্লাবের মোট ১৯জন কোভিড-১৯ পরীক্ষায় পজিটিভ হন। এর মধ্যে মূল দলের খেলোয়াড় ১৩জন। এদিকে চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রতিপক্ষ এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সফল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। তাদের মুখোমুখি হতে ক্লাবের যুব দলের খেলোয়াড়দের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল কাস্ত্রোকে। মূল দলের ১০জন খেলোয়াড় ছাড়াই রিয়ালের মুখোমুখি হওয়াকে ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে ‘দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাওয়া’ হিসেবে বলেছিলেন পর্তুগিজ এ কোচ।

রূপকথাই লিখেছে শাখতার।
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু আলফ্রেড ডি স্টেফানো অ্যারেনায় শেষ বাঁশি বাজার পর স্কোরবোর্ডে কী দেখলেন কাস্ত্রো! চোখ রগড়ে দেখলেও ফলটা বিশ্বাস করা কঠিন। সেটি শুধু কাস্ত্রো নয়, রিয়াল কোচ জিনেদিন জিদানের জন্যও—ধারে কিংবা ভারে তুলনাই চলে না এমন একটি ক্লাবের দ্বিতীয় সারির খেলোয়াড়দের কাছে রিয়াল হেরেছে ৩-২ গোলে! শাখতারের খেলোয়াড়দের যেন হারানোর কিছুই ছিল না, ওদিকে প্রায় সবকিছু থাকতেও রিয়ালের খেলা ছিল সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার মতো!

এই হারের আগে কিন্তু সতর্ক-ঘণ্টা শুনতে পেয়েছিল রিয়াল। লা লিগায় উঠে আসা কাদিজের কাছে গত শনিবার ঘরের মাঠে হেরেছে রিয়াল। কোচ জিনেদিন জিদান সে ম্যাচে মার্সেলোর পারফরম্যান্স দেখেও কাল রাতে কেন একাদশে রাখলেন সেটি বড় প্রশ্ন। সামনে ‘এল ক্লাসিকো’ থাকায় হাঁটুর চোটে ভোগা অধিনায়ক সার্জিও রামোসকে খেলানোর ঝুঁকি নেননি তিনি। তাই বলে আক্রমণভাগে করিম বেনজেমাও থাকবেন না! আর রক্ষণ? প্রথমার্ধে ফারল্যান্ড মেন্দি, এদের মিলিতাও, রাফায়েল ভারানে ও মার্সেলোদের রক্ষণ-দেয়ালকে স্রেফ ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছিল শাখতারের ২০ বছর বয়সী মিডফিল্ডার ম্যাতিয়াস তেতে ও ২১ বছর বয়সী উইঙ্গার মানোর সলোমন।

২৯ মিনিটে ভিক্টর ক্রোনিয়েঙ্কো ও তেতের চোখ জুড়ানো বল আদান-প্রদানের খেলায় গোল পায় শাখতার। ১৮ গজ বক্সের বাইরে অনেকটা নির্ভাবনায় খেলেছেন তারা। ক্রোয়েঙ্কোর পেছনে ‘মার্কার’ ভারানে লেগে থেকেও তাঁর পাস দেওয়া আটকাতে পারেননি। তবে বড় ভুলটা ছিল মার্সেলোর। ক্রোয়েঙ্কোকে থামাতে গিয়ে তেতে-কে ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেন গত প্রায় দুই বছর ধরে নিজের ছায়া হয়ে থাকা এ ব্রাজিলিয়ান লেফট ব্যাক। পাসটা পেয়ে বাঁ পায়ের শটে বল জালে জড়াতে ভুল হয়নি ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডারের। ভারানে সামনে থেকেও এ সময় তেতের শট রুখতে পারেননি। প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে এগিয়ে ছিল শাখতার, আর এই তিন গোলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান ছিল তেতের।

ম্যাচ শেষে রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থা এমনই।
ছবি: রয়টার্স

এগিয়ে যাওয়ার চার মিনিট পর ডান প্রান্তে বক্সের ভেতর থেকে জোরালো শট নিয়েছিলেন তেতে। গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া রুখে দিলেও ফিরতি বলে ‘আত্মঘাতী’ গোল করে বসেন বেচারা ভারানে! ফিরতি বল ‘ক্লিয়ার’ করতে গিয়ে রিয়ালকে ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে দেন ফরাসি ডিফেন্ডার। জিদানের রক্ষণভাগের ব্যর্থতার ষোলো কলা পূর্ণ হয় প্রথমার্ধের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ৩ মিনিট আগে। মানোর সলোমনকে বক্সে খেলার জায়গা করে দিয়েছিলেন মার্সেলো-ভারানেরা। তাঁর শট সামনে থেকেও রুখতে পারেননি ভারানে-মার্সেলোদের মতো অভিজ্ঞরা। চ্যাম্পিয়নস লিগে গত ১৫ বছরের মধ্যে কালই প্রথমবারের মতো প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল রিয়াল। শুধু কী তাই, চ্যাম্পিয়নস লিগে ঘরের মাঠে প্রথমার্ধ শেষে রিয়াল সর্বশেষ ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে—ভিনিসিয়ুসের তখন জন্মও হয়নি।

বিরতির পর বাধ্য হয়েই কৌশলে পরিবর্তন আনেন জিদান। প্রায় অকার্যকর হয়ে থাকা স্ট্রাইকার রদ্রিগোকে তুলে মাঠে নামান বেনজেমাকে। এরপর ৯ মিনিটের মাথায় গোল পায় রিয়াল। সেটি অবশ্য লুকা মদরিচের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে। ২৫ গজ দূর থেকে দুর্দান্ত শটে বল জালে জড়ান ক্রোয়াট মিডফিল্ডার। রিয়ালের ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় সত্যিকারের রসদ জুগিয়েছিলেন ভিনিসিয়ুস, ৫৮ মিনিটে বদলি হয়ে মাঠে নেমে। লুকা ইয়োভিচের বদলি হয়ে মাঠে নামার ১৫ সেকেন্ডের মাথায় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে বক্সে ঢুকে গোল করেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। ২০০৬-০৭ মৌসুম থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে গোলের সময়ের হিসেব রাখছে ‘অপটা’। তারপর থেকে এ প্রতিযোগিতায় বদলি হিসেবে নেমে এটি দ্রুততম গোলের রেকর্ড।

ভিনিসিয়ুস মাঠে নেমেই গোল করেছেন। কিন্তু জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি।
ছবি: রয়টার্স

ভিনিসিয়ুস ঘুরে দাঁড়ানোর আশা উসকে দেওয়ার পর ম্যাচের অন্তিম সময়ে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন ফেদে ভালভার্দে। ৯২ মিনিটে তাঁর শট শাখতারের জালে ঢুকলেও ‘অফ সাইড’ থাকার ‘অপরাধ’ করে বসেন ভিনিসিয়ুস। ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির (ভিএআর) সাহায্য নিয়ে গোলটি বাতিল করে দেন রেফারি, হার নিশ্চিত হয় রিয়ালের। ম্যাচের পর মদরিচ সোজাসাপ্টা বলেছেন, ‘প্রথমার্ধে আমরা এ প্রতিযোগিতার মানের দল ছিলাম না। আজ (কাল) প্রায় সবকিছুতেই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল, বিশেষ করে প্রথমার্ধে। কোনো সন্দেহ নেই উন্নতি করতে হবে।’

‘বি’ গ্রুপ থেকে অবিশ্বাস্য হারে চ্যাম্পিয়নস লিগ শুরু করায় শেষ ষোলোয় ওঠার লড়াইটা এখন কঠিন হয়ে গেল রিয়ালের। কাগজে-কলমে শাখতারই ছিল সবচেয়ে দুর্বল দল। এই গ্রুপ থেকে বাকি দুই প্রতিপক্ষ বরুসিয়া ম’গ্লাডবাখ ও ইন্টার মিলান।