বাংলাদেশের সঙ্গে শুরু করে ৫৩–তেও খেলছেন

৫৩ বছর বয়সেও পেশাদার ফুটবল খেলছেন কাজু মিউরাকাজু মিউরা অফিশিয়াল ওয়েবসাইট

এ যেন ক্লান্তিহীন এক যাত্রা। একটু ভুল বলা হলো। গৌরবের যাত্রায় আবার ক্লান্তি কী! এ যাত্রা তো প্রাপ্তির। জাপানি ফুটবল কিংবদন্তি কাজুইশো মিউরার যাত্রাটা এমনই। ৫৩ বছর বয়সেও যিনি পূর্ণোদ্যমে খেলে যাচ্ছেন পেশাদারি ফুটবল। এও কী সম্ভব! তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে।

অসম্ভব যে নয়, সেটি তো মিউরাই প্রমাণ করে দিয়েছেন। যে বয়সে কোচ কিংবা সংগঠক হয়ে যান খেলোয়াড়েরা, সেই বয়সেও তিনি জাপানি ক্লাব ইয়োকোহামা এফসির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ১৯৮৬ সালে ব্রাজিলে যে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মাত্র ১৯ বছর বয়সে, সে ক্যারিয়ারকেই তিনি দিয়েছেন প্রায় অমরত্ব। সে কারণেই জাপানি ঘরোয়া ফুটবল আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংবাদের তালিকায় না থাকলেও মিউরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নিয়মিত বিষয়। ফিফা-২০ কম্পিউটার গেমে মিউরার অন্তর্ভুক্তিও তাই গণমাধ্যমের জন্য লোভনীয় বিষয়।

কে এই কাজু মিউরা? কী কারণে এই বয়সেও তিনি খেলে যাচ্ছেন? তাঁর এই অনন্ত ক্যারিয়ারের নেপথ্য রহস্যটাই-বা কী? যেখানে একজন সেরা ফুটবলারের ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ১৫ বছর স্থায়ী হয়, সেখানে কীভাবে মিউরা ৩৪ বছর ধরে খেলে চলেছেন? তাঁর ক্যারিয়ার শুরুর পর জন্ম নেওয়া অনেক আন্তর্জাতিক ফুটবলারও যেখানে ‘বাতিল’ বা ‘বুড়ো’র তালিকায় পড়ে গেছেন!

৩৭ হাজার ৫৫২ ঘণ্টা পেশাদার ফুটবলের মঞ্চে কাটিয়ে দিয়েছেন মিউরা
কাজু মিউরা অফিশিয়াল ওয়েবসাইট

বিবিসিকে এ রহস্যের কিছু বলেছেন কাজু। যে রহস্যের শুরু, ১৯৭০ সালে—মেক্সিকো বিশ্বকাপ জিতে যেবার জুলেরিমে ট্রফি চিরতরে নিজেদের করে নিল পেলের ব্রাজিল। ফুটবলের প্রতি তাঁর নিরন্তর ভালোবাসা সৃষ্টির পেছনে পেলে, ব্রাজিল, ১৯৭০ বিশ্বকাপ ছাড়াও আছে একটি ৮ মিলিমিটার ক্যামেরা।

মিউরার জন্ম এক ফুটবল-পাগল পরিবারে। জাপানের শিজুওকাতে জন্ম তাঁর। মিউরার বড় ভাই ইয়াসুতোশি পেশাদার ফুটবল খেলেছেন। বাবা ছিলেন ফুটবলের জন্য রীতিমতো পাগল। মিউরার বাবা ১৯৭০ সালে মেক্সিকো গিয়েছিলেন বিশ্বকাপ দেখার উদ্দেশ্যে, ‘আমার বাবা ছিলেন দারুণ ফুটবল ভক্ত। ১৯৭০ বিশ্বকাপ দেখতে মেক্সিকো গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে তাঁর ৮ মিলিমিটার ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে পেলের একটি খেলা ভিডিও করেছিলেন। আমি বড় হয়েছি বাবার নিজ হাতে তোলা পেলের সেই ভিডিও দেখে দেখে।’

১৯৯০ বেইজিং এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন মিউরা
কাজু মিউরা অফিশিয়াল ওয়েবসাইট

আজ থেকে ৫১ বছর আগে মিউরার বয়স ছিল মাত্র ৩। ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ারে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা সেই ভিডিওই তাঁকে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছ, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই আমি ব্রাজিলের ভক্ত। আমি তখন থেকেই পেলের মতো একজন পেশাদার ফুটবলার হতে চেয়েছি।’

কিন্তু জাপানে একটা সময় পেশাদারি ফুটবল ছিল অনেক দূরের বিষয়। সূর্যোদয়ের দেশে বসে কেউ পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখলে সেটি ছিল অসম্ভব এক ব্যাপার। কিন্তু মিউরার স্বপ্ন ছিল অনেক দূর বিস্তৃত। বাবাও বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের স্বপ্নের পরিধি। তাই ১৫ বছর বয়সেই জাপান ছেড়ে মিউরাকে ব্রাজিল পাড়ি দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, ‘জাপানে বসে আমি পেশাদার ফুটবলার হতে পারতাম না। ১৫ বছর বয়সে শিজুওকা ছেড়ে আমি ব্রাজিলে চলে গেলাম। বাবার কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল ব্রাজিলে। সেখানে তাঁর যথেষ্ট জানাশোনাও ছিল। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন জাপানে কোনো পেশাদার লিগ ছিল না (১৯৯৩ সালে জাপানে পূর্ণ পেশাদার জে-লিগ চালু হয়)।’

ব্রাজিলে মিউরার প্রথম দলের নাম ছিল জুভেন্টাস। সাও পাওলোতে সেই সময়টা বড্ড কঠিন ছিল মিউরার। সেখানে একটা ডর্মে থাকতেন অন্যান্য তরুণ ফুটবলারের সঙ্গে। কিন্তু ভাষাগত সমস্যা ছিল প্রকট। সেই কঠিন দিনগুলিতে রীতিমতো সংগ্রাম করেই কাটাতে হয়েছিল মিউরাকে, ‘আমি ভাষা বুঝতাম না। সংস্কৃতি পুরোপুরি ভিন্ন ছিল ব্রাজিলে। আমি মারাত্মক একাকিত্বে ভুগতাম। ব্রাজিলে প্রথম তিন মাস ছিল ভয়ংকর কঠিন।’

কিন্তু সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তো মিউরা নন। তিনি পর্তুগিজ ভাষা শিখলেন। ব্রাজিলীয় সংস্কৃতির বোঝার চেষ্টা করলেন। বন্ধু বানালেন অনেককে। নিজের স্বার্থেই করলেন। তাঁকে যে সফল হতেই হবে। চোয়ালবদ্ধ সেই প্রতিজ্ঞার ফলই তিনি ভোগ করেছেন সারাটা জীবন ধরে। ফুটবল হওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হলে তিনি যে ভেসে যেতেন। অন্য কিছু করার সামর্থ্য যে তাঁর ছিল না। ফুটবলার হওয়াটাই যে ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।

জাপানি কিংবদন্তির বিশ্বকাপ খেলা হয়নি
ফাইল ছবি, রয়টার্স

সেই লক্ষ্যটাই তিনি পূরণ করেছিলেন ১৯ বছর বয়সে। পেলের ক্লাব সান্তোসেই তিনি শুরু করেছিলেন পেশাদারি ক্যারিয়ার। ১৯৮৬ সালে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানো নয়। ৩৫ মৌসুম কাটিয়ে দিয়েছেন পেশাদারি ফুটবল দুনিয়ায়। নিজেকে পরিণত করেছেন ‘কিং কাজু’-তে।

৫০ পেরিয়েই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে তিনি ভেঙে দেন স্যার স্ট্যানলি ম্যাথুজের রেকর্ড। ১৯৬৫ সালে বুটজোড়া তুলে রাখার দিন ম্যাথুজের বয়স ছিল ৫০ বছর ৭ দিন। মিউরা ভেঙে দেন ৫০ বছর বয়সী পুরোনো রেকর্ড। সবচেয়ে বেশি বয়সে পেশাদার ফুটবল খেলার রেকর্ড।

জাপানের হয়ে ৮৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৫৫ গোল তাঁর
ফাইল ছবি, এএফপি

জাপানের কিংবদন্তিসম ফুটবলার তিনি। অথচ একটা বারের জন্যও বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তাঁর। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে জাপানের খেলা হয়নি শেষ মুহূর্তের দুর্ভাগ্যের কারণে। ইরাকের বিপক্ষে ম্যাচে জিতলেই বিশ্বকাপে পৌঁছে যেত জাপান। কিন্তু ২ গোলে এগিয়ে থাকা সে ম্যাচ শেষপর্যন্ত ড্র হয় ২-২ গোলে। ইরাক শেষ মুহূর্তে সমতা না ফেরালে হয়তো কাজুর স্বপ্ন পূরণ হয়ে যেত। ক্যারিয়ারের সেরা সময় যে তাঁর ওই সময়টাই। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে যখন জাপান প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পেল, তখন তিনি বাদ পড়ে গেলেন। বিশ্বকাপ না খেলার আক্ষেপ হয়তো ভোলার চেষ্টা করতে পারেন নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়েই। দেশের হয়ে ৮৬ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৫৫টি গোল তো গর্ব করার মতোই।

জাপানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা মিউরা
ফাইল ছবি, এএফপি

আন্তর্জাতিক ফুটবলে এক ম্যাচে ৬ গোল করারও অনন্য কীর্তি আছে তাঁর। ১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ম্যাকাওকে ১০-০ গোলে হারিয়েছিল জাপান। টোকিওতে সে ম্যাচে মিউরা একাই করেছিলেন ৬ গোল। মিউরার গোলের খিদে পুড়িয়েছে বাংলাদেশকেও। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর গোল ৬টি। এর মধ্যে এক ম্যাচেই আছে ৪ গোল। ১৯৯৩ সালে টোকিওতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৮ গোল হজমের দুঃস্বপ্নের মধ্যে মিউরার পা থেকে এসেছিল ৪ গোল। বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর প্রথম গোল ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে। এটাই ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেকের ম্যাচ। সে ম্যাচে ৩-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। একটি গোল আছে ১৯৯৩ বাছাইপর্বেই ফিরতি পর্বে দুবাইয়ে। সে ম্যাচে জাপান জিতেছিল ৪-১ গোলে।

শুধু জে লিগেই (জাপানের শীর্ষ লিগ) ৩৭ হাজার ৫৫২ ঘণ্টা ফুটবল মাঠে কাটিয়ে দিয়েছেন এ জাপানি তারকা। যে লিগে গোল সংখ্যা ১৬৩। ক্লাব ক্যারিয়ার ও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার যোগ করলে সেটা আড়াই শ ছাড়িয়ে যায়—আর কী চাই তাঁর। আর কি পেতে তিনি এখনো খেলে যাচ্ছেন ফুটবল। কারণটা কি?

বিবিসিকে তিনি এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি কেবল একটা কথাই বলেছেন, ‘প্যাশন’। ১৯৮৬ সালে সান্তোসে খেলতে গিয়ে তিনি বলে লাথি দিয়ে যে আনন্দ পেতেন, সেই আনন্দের পরিমাণটা যে বেড়েছে! খেলে যখন আনন্দ পাচ্ছেন, তখন খেলা চালিয়ে যেতে দোষ কি! বয়স তো কেবলই একটা সংখ্যা!