সালাহর প্রতি হিংসা থেকেই তাঁর সতীর্থের এই ‘সততা’ দেখানো?

সালাহর প্রতি হিংসা আছে মানের?ছবি: রয়টার্স

সাদিও মানে যা করেছেন, সাদাচোখে সেটা সব ফুটবলারেরই করা উচিত। প্রতিপক্ষ বক্সে গায়ে আলতো স্পর্শেই যেখানে পড়ে যান এ যুগের অধিকাংশ ফুটবলার, চেষ্টা করেন অভিনয় করে পেনাল্টি আদায় করে নেওয়ার, সেখানে মানে সততার দারুণ উদাহরণ হয়ে থাকছেন নিয়মিতই।

প্রতিপক্ষের স্পর্শে একেবারে ভারসাম্য না হারিয়ে ফেললে সাধারণত পড়ে যান না লিভারপুলের সেনেগালিজ উইঙ্গার, খেলা চালিয়ে যান। চেলসির বিপক্ষে কাল লিগে নিজেদের মাঠে লিভারপুলের ১-০ হারের ম্যাচেও তা-ই করেছেন। বক্সে চেলসি ডিফেন্ডার অ্যান্টোনিও রুডিগারের ট্যাকলের পরও খেলা চালিয়ে গেছেন মানে।

সেই মানেকে নিয়ে এমন এক ‘তত্ত্ব’ বের করলেন লিভারপুলেরই সাবেক স্ট্রাইকার মাইকেল ওয়েন? সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকারের কথাগুলো শুনে অবশ্য ভ্রু কুঁচকে যেতে পারে অনেকের। ওয়েনের মনে হচ্ছে, সালাহর প্রতি হিংসা থেকেই প্রতিপক্ষের ফাউলে পেনাল্টি আদায়ের চেষ্টা না করে খেলা চালিয়ে যান মানে।

মানের এই সততা দেখানোর সঙ্গে সালাহর সম্পর্ক কী? লিভারপুল পেনাল্টি পেলে যে সেগুলো সালাহই নেন। আর সালাহ গোল পান, সেটা মানে চান না বলেই মনে হচ্ছে ওয়েনের।

লিভারপুলের একাডেমিতে বেড়ে ওঠার পর লিভারপুলের জার্সিতে অনেক দিন আলো ছড়ালেও পরে রিয়াল মাদ্রিদ, নিউক্যাসল ঘুরে লিভারপুলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলেছেন ওয়েন। সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকারকে তাই লিভারপুলের অনেক সমর্থকই নিজেদের একজন বলে মেনে নিতে চান না। সালাহ-মানেকে নিয়ে তাঁর এই মন্তব্যের পর ওয়েন হয়তো লিভারপুল সমর্থকদের আরও বিরাগভাজন হবেন।

অ্যান্টোনিও রুডিগারের ট্যাকলে পড়ে যাননি মানে।
ছবি: রয়টার্স

কোন ঘটনার পর ওয়েনের এমন প্রতিক্রিয়া? অ্যানফিল্ডে গতকাল ম্যাচের ৮ মিনিটের ঘটনা সেটি। চেলসি বক্সে বল নিয়ে ছুটতে থাকা মানেকে ট্যাকল করেন রুডিগার। চেলসির ডিফেন্ডার বলের নাগাল পাননি, তাঁর পা লাগে মানের পায়ে। মানে সে সময় পড়ে গেলেই লিভারপুল পেনাল্টি পেত। কিন্তু লিভারপুল ফরোয়ার্ড পড়ে যাননি। কসরত করে ভারসাম্য ধরে রাখেন। কিন্তু এই সততা লিভারপুলকে ভুগিয়েছে বটে! নিজের ভারসাম্য ফিরে পেলেও বলের নিয়ন্ত্রণ এরপর রাখতে পারেননি মানে, লিভারপুল গোল করার সুযোগও পায়নি।

শেফিল্ড ইউনাইটেডের বিপক্ষে লিগে লিভারপুলের সর্বশেষ ম্যাচেও বক্সে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের ট্যাকলে এভাবে পড়ে না গিয়ে খেলা চালিয়ে যান মানে। সে ম্যাচে অবশ্য লিভারপুল জিতেছিল। কিন্তু পরপর দুই ম্যাচে মানের এমন সততার অন্য ব্যাখ্যা খুঁজে বের করেছেন ওয়েন। অপটাস স্পোর্টে সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকারের বিস্ময়, ‘প্রথমার্ধে ওই ঘটনাটার সময় প্রত্যেক লিভারপুল–ভক্তই ভেবেছিলেন, “পেনাল্টি পেলাম বলে!” আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না ও (মানে) পড়ে যায়নি তখন।’

এরপরই নিজের অদ্ভুত তত্ত্ব দিয়েছেন ওয়েন, ‘আমি এটা বলছি না যে (প্রতিপক্ষের আলতো স্পর্শেই) এভাবে পড়ে যাওয়াকে আমি সমর্থন করি, কিন্তু সাধারণত এ সময়ের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা এসব ক্ষেত্রে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি ভাবি, ওর মাথায় কি এটা কাজ করছিল যে, “এক মিনিট! এখানে আগে আমিই গোল করার চেষ্টা করা উচিত। কারণ, আমি মাটিতে পড়ে গেলে মো সালাহ আরেকটা পেনাল্টি থেকে গোল করার সুযোগ পাবে।”’

সালাহকে আগেভাগে তুলে নেন ক্লপ।
ছবি: রয়টার্স

সালাহ ও মানের মধ্যে যে একটা হিংসার মনোভাব আছে, সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায় একধরনের স্বার্থপরতা আছে...এমন গুঞ্জন ইংলিশ সংবাদমাধ্যমে অনেক দিন ধরেই চলছে। গত মৌসুমে বার্নলির বিপক্ষে লিভারপুলের ম্যাচ থেকে যেটি আওয়াজ পেয়েছে। সে ম্যাচে মানে গোল করার মতো সুবিধাজনক জায়গায় থাকার পরও তাঁকে পাস না দিয়ে নিজেই অযথা শট নেন সালাহ। অথচ তাঁর শটে গোল হওয়ার সম্ভাবনা কম, সেটা সাধারণ দর্শকও বুঝতে পারছিলেন। মানে সে সময় মাঠেই বেশ চিৎকার-চেঁচামেচি করে নিজের রাগ প্রকাশ করেন।

এরপরও অনেকবারই সালাহ-মানের ক্ষেত্রে এ রকম দেখা গেছে, যেখানে একজন গোল করার মতো অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গায় আছেন দেখেও অন্যজন তাঁকে পাস দেননি, নিজেই গোল করার চেষ্টা করেছেন।

একজন ফরোয়ার্ডের কিছুটা স্বার্থপর হতেই হয়—এটা ফুটবলের আপ্তবাক্য। কিন্তু স্বার্থপরতা আর হিংসার মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেওয়া রেখাটিও হিসাবে রাখতে হয়। মানে-সালাহ তা রাখেননি বলেই মনে হচ্ছে ওয়েনের, ‘সবাই জানি আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা কত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মানসিকতার হয়। স্ট্রাইকাররা একটু স্বার্থপর হয়ই। গত কয়েক মৌসুমে দুজনই গোল্ডেন বুটের (লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার) জন্য লড়েছে।’

বদলি হয়ে উঠে যাওয়ার পর হতাশ সালাহ।
ছবি: রয়টার্স

২০১৭-১৮ মৌসুমে সালাহ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। এরপরের মৌসুমে আর্সেনালের পিয়ের এমেরিক অবামেয়াংয়ের পাশাপাশি সালাহ ও মানে—তিনজনই হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা।

এই মৌসুমে অবশ্য সালাহ সেরা গোলদাতা হওয়ার দৌড়ে থাকলেও মানে ধারেকাছেও নেই। লিভারপুল গত দুই-তিন মাসে ধুঁকলেও এখন পর্যন্ত ১৭ গোল নিয়ে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা সালাহ, তালিকায় দুই নম্বরে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মিডফিল্ডার ব্রুনো ফার্নান্দেজের চেয়ে ২ গোল বেশি তাঁর। সেখানে মানে মাত্র ৭ গোল নিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ২০তম। এই মৌসুমে লিভারপুলের খাবি খাওয়ার পেছনে অসংখ্য চোটের পাশাপাশি আক্রমণভাগে মানে ও রবার্তো ফিরমিনোর গোল করতে ভুলে যাওয়াও বড় কারণ বলে মানা হয়।

কিন্তু দৌড়ে না থাকলেও সালাহর প্রতি হিংসা মানের ঠিকই ছিল বলে মনে হচ্ছে ওয়েনের, ‘আমি শুধু এটাই ভাবছি...হয়তো আমি যা বলছি সেটার বাস্তবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই...কিন্তু যখন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ও (মানে), ভাবছিল হয়তো শট নিতে পারবে, তখন হয়তো ও এটাই ভাবছিল যে, “এটা আমার গোল করার সুযোগ।” ওর আর মো সালাহর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই এমন। হয়তো আমার তত্ত্বটাকে অনেক ভিত্তিহীন মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা আগেও দেখেছি যে একজন গোল করার জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো জায়গায় থাকার পরও আরেকজন তাঁকে পাস দিচ্ছে না। সে কারণেই এমন তত্ত্ব মাথায় আসছে।’

টানা দুই ম্যাচে মানের এভাবে পেনাল্টি আদায় না করার সততা দেখে ওয়েন তাই এখন অন্য কিছু ভাবছেন, ‘আমরা এখানে কথা বলছি স্বার্থপরতার। কারও একটু মুখ গোমড়া করে রাখার, যেটা আমরা আজ দেখেছি সালাহর মধ্যে, (৬২ মিনিটে লিভারপুল কোচ ক্লপ সালাহকে তুলে নেওয়ার পর) ও মাথা নাড়াচ্ছিল। আমরা জানি ওরা দুজনই কত বেশি করে গোল্ডেন বুট জিততে চায়। আমার মনে হয় এর আগে আমি ওকে (মানে) দেখেছি এমন ট্যাকলের ক্ষেত্রে পড়ে যেতে। কিন্তু টানা দুই ম্যাচে এমন সুযোগ পাওয়ার পরও পড়ে না যাওয়া...এটা আমাকে ভাবাচ্ছেই।’