সাড়ে তিন বছরের জাদুর শেষে দীর্ঘশ্বাসে বিদায় আর্জেন্টাইন পাগলের

লিভারপুলের কিংবদন্তি মিডফিল্ডার ও বর্তমানে অ্যাস্টন ভিলার কোচ জেরার্ডের পাশে বিয়েলসাছবি: রয়টার্স

জাদু? তা-ই তো!

নিজেদের মাঠে টটেনহামের কাছে কাল ৪-০ গোলে হারের পর যখন মার্সেলো বিয়েলসার লিডস ইউনাইটেড ছেড়ে যাওয়ার গুঞ্জন ছড়াল, ইংলিশ ক্রীড়া দৈনিক দ্য অ্যাথলেটিকের লিডস ইউনাইটেড প্রতিনিধি ফিল হেই টুইটে এ শব্দটাই নিয়ে এলেন সবার আগে, ‘এই মৌসুমে ধুঁকলেও লিডসে বিয়েলসার বছরগুলো জাদুকরি, অনন্য হিসেবেই মনে থেকে যাবে সব সময়।’ সম্ভবত ইংলিশ ক্লাবটির কোনো সমর্থক নেই, যিনি এই বাক্যে দ্বিমত করবেন!

জাদুকরি অধ্যায়ের শেষ হচ্ছে, সে তো গতকালই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে আজ, লিডস ইউনাইটেড বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছে, বিয়েলসার সঙ্গে গাঁটছড়া শেষ হয়ে গেছে ক্লাবটির। ৬৬ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন কোচ, যাঁকে ভালোবেসে সবাই ‘এল লোকো’ (পাগল) বলে ডাকে, তাঁর শেষটা হলো দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে!

দীর্ঘশ্বাস তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারেরই শিরোনাম হতে পারে। ম্যানচেস্টার সিটির বর্তমান পেপ গার্দিওলা, পিএসজির মরিসিও পচেত্তিনোর মতো কোচদের ‘গুরু’ তিনি, ফুটবলকে তাঁর মতো করে বিশ্লেষণ করতে পারার মতো কোচ কমই আছেন! ফুটবলেই খাওয়া, ফুটবলেই নিশ্বাস তাঁর। কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে গ্রুপ পর্বে বিদায় পড়া বিয়েলসার প্রায় তিন দশকের কোচিং ক্যারিয়ারে সাফল্যই তেমন নেই। তাঁর দল সব সময় গতিময় আক্রমণাত্মক ফুটবলই খেলে, কিন্তু সাফল্য যেন ধরা দিতে চায় না তাঁকে!

তাঁর অধীনে বাতিস্তুতা, ওর্তেগা, আইমারদের আর্জেন্টিনা দাপট দেখিয়ে ২০০২ বিশ্বকাপে গিয়েও বাদ পড়েছে গ্রুপ পর্বে, ২০০৪ কোপা আমেরিকায় হয়েছে রানার্সআপ। শুধু ২০০৪ অলিম্পিকটাই জিতেছে!

নব্বইয়ের দশকে আর্জেন্টাইন লিগে তিনবার শিরোপা জিতলেও এ শতকে এসে স্পেনের অ্যাথলেটিক বিলবাওকে নিয়ে ২০১২ স্প্যানিশ কাপ ও ইউরোপা লিগ দুটিরই ফাইনালে নিয়ে গিয়ে হেরেছেন।

শিরোপা না এলেও বিলবাওয়ে যেমন জাদু ছড়িয়েছিলেন, লিডসেও বিয়েলসার গল্পটা তেমনই। গল্পটার শুরু ২০১৮ সালের জুনে, লিডস তখন ইংলিশ ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপে। তাঁর আক্রমণাত্মক ফুটবলের দর্শন লিডসের সমর্থকদের মন ছুঁয়ে গেলেও প্রথম মৌসুমে লিডস সাফল্য ছুঁতে পারেনি। প্লে-অফে হেরে যাওয়ায় খুব কাছে গিয়েও প্রথম বিভাগে ওঠা হয়নি।

সুন্দর ফুটবলে গত মৌসুমে লিডসকে ১৬ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে ফিরিয়েছিলেন বিয়েলসা
ছবি: রয়টার্স

তবে পরের মৌসুমে সৌন্দর্য আর সাফল্যের মিশেলে অবিশ্বাস্য নয়টি মাস কেটেছে লিডসের! ১০ পয়েন্টের ব্যবধানে দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা জিতে লিডস ১৬ বছর পর উঠে আসে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। বিয়েলসা ফিফার বর্ষসেরা কোচের দৌড়ে পেলেন তৃতীয় পুরস্কার।

প্রিমিয়ার লিগে উঠেও কী দারুণ দেখাল লিডস! লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যান সিটি, চেলসিদের ভিড়ে নেমেও গত মৌসুমে ভড়কে যায়নি লিডস। চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে বিয়েলসার দল। মৌসুমে লিগে নবম হওয়ার পথে ২০০০-০১ মৌসুমের পর প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসা কোনো দলের সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়ার রেকর্ডও গড়ল।

শুধু সাফল্য কেন, সব সময় হাশিখুশি, স্বচ্ছ চরিত্রের বিয়েলসার জন্য আলাদা টান অনুভব করেননি, এমন লিডস সমর্থক সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিয়েলসাও তো দায়িত্বের বাইরে গিয়ে ক্লাবের সমর্থকদের জন্য কম করেননি! সেটি কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া হোক বা বাস থেকে নেমে সমর্থকদের সঙ্গে ছবি তোলার আবদার মেটানো!

কিন্তু এই মৌসুমে এসে গল্পটাতে ছেদ পড়ল। বিয়েলসার জন্য সমর্থকদের টান একই আছে, কিন্তু মাঠে উড়তে থাকা লিডসের ডানা খসে গেল! আজ এই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের চোট তো কাল ওই খেলোয়াড়ের। করোনায় ক্লাবের উদ্বৃত্তপত্রেও ধাক্কা লেগেছে বলেই কিনা, মৌসুমে খেলোয়াড় কেনায় তেমন বিনিয়োগও করেনি লিডস। বিয়েলসার আক্রমণাত্মক ফুটবলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলার মতো খেলোয়াড় তাহলে আর থাকল কোথায় লিডসের! এত চোট আর এত খেলোয়াড়ের অভাবের মধ্যে বিয়েলসাও কি একটু বেশি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার মূল্য দিলেন? হয়তো!

শেষটা সুন্দর হলো না বিয়েলসা আর লিডসের
ছবি: রয়টার্স

সব মিলিয়ে ফল, এখন পর্যন্ত লিগে ২৬ ম্যাচে মাত্র ৫ জয় লিডসের, হেরেছে ১৩টি। ম্যান ইউনাইটেড, ম্যান সিটি, লিভারপুল—তিন দলের কাছেই গোলে ভেসেছে। মৌসুমে এখন পর্যন্ত গোল করেছে মাত্র ২৯টি, কিন্তু খেয়েছে ৬০টি! ২৩ পয়েন্ট নিয়ে লিডস আছে অবনমন অঞ্চলের দুই ধাপ ওপরে।

অবনমন অঞ্চলের তিন দলের মধ্যে সবার ওপরেরটি—অর্থাৎ পয়েন্ট তালিকায় ১৮তম বার্নলির পয়েন্ট ২১। তবে ১৭তম স্থানে থাকা এভারটন (২২ পয়েন্ট) আর ১৮তম বার্নলি—দুই দলই লিডসের চেয়ে দুটি করে ম্যাচ কম খেলেছে! অর্থাৎ বার্নলি ও এভারটন নিজেদের দুই ম্যাচের একটি করে জিতলেও লিডস নেমে যাবে অবনমন অঞ্চলে।

ক্লাবের মালিকপক্ষের কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। চেয়ারম্যান আন্দ্রেয়া রাদ্রিজ্জানি তা-ই বলেছেন, ‘মার্সেলো ক্লাবে যত সাফল্য পেয়েছেন, সেসব বিবেচনায় নিয়ে বলছি, লিডস ইউনাইটেডে আমাদের দায়িত্ব পালনকালে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটাই নিতে হলো আমাকে। মার্সেলো আমাদের প্রধান কোচ হয়ে আসার পর অবিশ্বাস্য তিন মৌসুমে এলান্ড রোডে (লিডসের স্টেডিয়াম) সুন্দর সময় ফিরেছিল। কিন্তু আমাকে এখন ক্লাবের ভালোর জন্যই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, আর প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকার জন্য এখনই নতুন প্রধান কোচ নিয়ে আসার সঠিক সময় বলে মনে হচ্ছে।’

লিডসের ফুটবল পরিচালক ভিক্টর ওর্তা বললেন, ‘তিনি একটা লিগ্যাসি রেখে যাচ্ছেন। থর্প আর্চে (লিডসের অনুশীলন মাঠ) অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকটি দেখভাল করেছেন, সমর্থক ও খেলোয়াড়দের এক করেছেন, একাডেমির তরুণদের মূল দলে উঠে আসার পরিষ্কার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন। গত কয়েক বছর আমরা যতটা উপভোগ করেছি, যেটা কিনা আমার ক্যারিয়ারের সেরা সময়, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বলি, খুব খারাপ লাগছে যে তাঁর মেয়াদের শেষটা এভাবে হচ্ছে!’

আগামীকালই বিয়েলসার বদলে নতুন কোচের নাম ঘোষণা করার সম্ভাবনার কথা বিবৃতিতে জানিয়েছে লিডস। তবে গতকাল থেকে ইংলিশ সংবাদমাধ্যমে গুঞ্জন, জার্মান ক্লাব লাইপজিগ থেকে কদিন আগে বরখাস্ত হওয়া আমেরিকান কোচ জেসি মার্শ হতে যাচ্ছেন বিয়েলসার উত্তরসূরি।