সিটিতে আগুয়েরোর বিকল্প হতে পারেন যাঁরা

মৌসুম শেষেই ম্যানচেস্টার সিটি ছাড়বেন সের্হিও আগুয়েরো।ছবি: টুইটার

মৌসুমের আগে থেকেই গুঞ্জনটা শোনা যাচ্ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সের্হিও আগুয়েরোর পোস্ট সে গুঞ্জনকেই বৈধতা দিয়েছে যেন। আগুয়েরোর সঙ্গে ম্যানচেস্টার সিটির ১০ বছরের সম্পর্কটা চুকেবুকে যাচ্ছেই।

আর্জেন্টাইন এই স্ট্রাইকারের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করছে না পেপ গার্দিওলার দল। ৪৪ বছর পর ২০১১-১২ মৌসুমে সিটির যে দল লিগ শিরোপা জিতেছিল, সে দলের সর্বশেষ সদস্য এই আগুয়েরো।

আগুয়েরো যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে আলোচনা। ২৭১ লিগ ম্যাচ খেলে ১৮১ গোল করা, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৫৭ গোল করা এই স্ট্রাইকারের বিকল্প হিসেবে সিটি কাকে বা কাদের দলে আনবে?

আগুয়েরোর মতো একজন স্ট্রাইকার, যাকে অনায়াসে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম স্ট্রাইকার বলা যায়, তাঁর জায়গায় বিকল্প হিসেবে সিটি কাকে আনবে?

এই মৌসুমে চোটগ্রস্ত আগুয়েরোর জায়গায় কোচ পেপ গার্দিওলা অনেককেই খেলিয়েছেন। এমন এক কৌশলে দলকে খেলাচ্ছেন, যেখানে স্ট্রাইকারের দরকারই নেই।

রাহিম স্টার্লিং, ফিল ফোডেন, রিয়াদ মাহরেজ, ফেরান তোরেস, বের্নার্দো সিলভা—সবাই ঘুরেফিরে ‘ফলস নাইন’ হিসেবে খেলেছেন। সঙ্গে গাব্রিয়েল জেসুস তো আছেনই। এ কৌশলে দলকে খেলিয়ে এ পর্যন্ত বেশ সাফল্য পেয়েছেন গার্দিওলা। এখনো এই মৌসুমে চারটি শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে সিটির।

আগুয়েরোর শূন্যতা পূরণে নিখাদ স্ট্রাইকার খুঁজবে ম্যানচেস্টার সিটি।
ছবি: টুইটার

কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই একজন নিখাদ স্ট্রাইকারের অভাব বড্ড ভুগিয়েছে সিটিকে। জেসুস প্রত্যাশামতো সেভাবে খেলতে পারেননি। ফলে আগুয়েরো-পরবর্তী যুগে তাঁর ওপরও যে গার্দিওলা চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখতে পারবেন, মনে হচ্ছে না। স্ট্রাইকার লাগবেই সিটির।

একজন তো অবশ্যই, প্রয়োজনভেদে দুজনও হতে পারে। কিন্তু কাদের দলে এনে সিটি আগুয়েরোর শূন্যতা পূরণ করবে? বেশ কিছু নাম উঠে এসেছে আলোচনায়:

আর্লিং হরলান্ড (নরওয়ে, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড)

আগুয়েরোর বিকল্প হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে স্ট্রাইকারের নাম আলোচনায় আসছে, তিনি জার্মান ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার আর্লিং হরলান্ড। প্রথমে রেড বুল সালজবুর্গ, পরে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড—ক্লাব ক্যারিয়ারে মুড়িমুড়কির মতো গোল করা এই স্ট্রাইকারকেই পাখির চোখ করেছেন গার্দিওলা।

লিগে এর মধ্যেই ২১ ম্যাচ খেলে ২১ গোল করে ফেলেছেন হরলান্ড, সহায়তা করেছেন আরও ৫টি গোলে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩১ ম্যাচে ৩৩ গোল হয়ে গেছে হরলান্ডের, গোল সহায়তা ৩টি। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে একের বেশি গোল করছেন ২০ বছর বয়সী এই গোলমেশিন। ডর্টমুন্ডের ৭৬ শতাংশ গোলে অবদান আছে তাঁর।

বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার আর্লিং হরলান্ড।
ছবি: টুইটার

স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজোড়া বড় বড় সব ক্লাবের নজর পড়েছে হরলান্ডের দিকে। শুধু সিটিই নয়, চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা—সবাই ছুটছে এই সোনালিচুলো ছেলের পেছনে। সুযোগ বুঝে ডর্টমুন্ডও হরলান্ডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে চড়চড় করে।

জানিয়েছে, ১৮ কোটি ইউরো বা প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার কমে হরলান্ডকে ছাড়তে রাজি নয় তারা। জার্মান ক্লাবটার সঙ্গে হরলান্ডের চুক্তি যেহেতু ২০২৪ সালে শেষ, সেহেতু এর আগে এই তারকাকে দলে চাইলে আকাশছোঁয়া ওই দামই দিতে হবে আগ্রহী ক্লাবকে।

অবশ্য সিটির কাছে টাকাপয়সা চিন্তার বিষয় ছিল কবে? গার্দিওলা যদি আসলেই এই তারকাকে চান, প্রয়োজন হলে ১৮ কোটি ইউরো দিয়েই দলে আনবেন এই নরওয়েজিয়ানকে।

রোমেলু লুকাকু (বেলজিয়াম, ইন্টার মিলান)

সিটির পছন্দের তালিকায় থাকা পরবর্তী স্ট্রাইকারের অবশ্য ম্যানচেস্টারে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। সিটিতে নয়, ইউনাইটেডের হয়ে দুই মৌসুম খেলেছিলেন বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। এভারটনের হয়ে আলো ছড়িয়ে ‘রেড ডেভিলস’দের খাতায় নাম লেখালেও ইউনাইটেডের হয়ে অত ভালো খেলতে পারেননি।

ইন্টার মিলানে গিয়ে ইতালিয়ান কোচ আন্তোনিও কন্তের অধীন খেলছেন দুর্দান্ত। চলতি মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৪ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ২৫টি, সহায়তা ৭ গোলে। লিগে গোল ১৯টি।

কন্তে এর আগে যতগুলো ক্লাবের ম্যানেজার ছিলেন, প্রতিটি ক্লাবেই লুকাকুকে চেয়েছিলেন। জুভেন্টাস ও চেলসিতে জুভেন্টাসকে দলে আনতে ব্যর্থ হলেও এবার ইন্টারের মালিকপক্ষ কন্তের এ আশা পূরণ করেছেন। ফলাফল? ১০ বছর পর এবার প্রথমবারের মতো ইতালিয়ান লিগে জুভেন্টাসের আধিপত্য ধ্বংস করার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে ইন্টার মিলান। আর সে আধিপত্য ধ্বংসের কাজে লুকাকুই যে ইন্টারের মূল সারথি, সে কথা আর না বলে দিলেও চলছে।

ইন্টার মিলানের বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু।
ছবি: টুইটার

তবে আট কোটি ইউরোর বিনিময়ে দলে আনা এই স্ট্রাইকারকে ইন্টারও যে সহজে আনবে না, এটা সহজেই অনুমেয়। পেপ গার্দিওলা সাধারণত যে ধরনের স্ট্রাইকার খেলিয়ে অভ্যস্ত, লুকাকু ঠিক তেমন নন। লুকাকুর খেলার ধরনের এই বৈচিত্র্যই সিটিকে আরও আগ্রহী করে তুলেছে। ২৭ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের মতো একজন দলে থাকলে সিটির আক্রমণে বৈচিত্র্য আসবে, এমনটাই মনে করছেন অনেকে।

ওদিকে হরলান্ডের মতো লুকাকুর মুখপাত্রও মিনো রাইওলা, মক্কেলের ক্লাব পরিবর্তনের সময় যিনি চড়া অঙ্কের কমিশন নিয়ে থাকেন। সবকিছু মিলিয়ে সিটি সাবেক এই ইউনাইটেড আর চেলসি স্ট্রাইকারকে দলে আনে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

লাওতারো মার্তিনেজ (আর্জেন্টিনা, ইন্টার মিলান)

শুধু লুকাকুই নন, সিটির পছন্দের তালিকায় আছেন ক্লাবে তাঁর স্ট্রাইক-সঙ্গী লাওতারো মার্তিনেজও। ইন্টারকে লিগ শিরোপার সুবাস পাইয়ে দেওয়ার কাজটা লুকাকুর পাশাপাশি এই আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারও করছেন বেশ ভালোভাবে। গত দলবদলের সময়ে বার্সেলোনার পাশাপাশি পেপ গার্দিওলার সিটিও চেয়েছিল এই স্ট্রাইকারকে। কিন্তু ইন্টার সাফ জানিয়ে দেয়, ১১ কোটি ১০ লাখ ইউরোর এক পয়সাও কম নেবে না তারা এই আর্জেন্টাইনের জন্য।

সেবার তা-ও ক্লাবে আগুয়েরো ছিলেন দেখে সিটি আর কথা বাড়ায়নি। এবার আগুয়েরোও নেই। এক আর্জেন্টাইনের অভাব সিটি আরেক আর্জেন্টাইন দিয়ে পূরণ করে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৩ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন ৩৭ ম্যাচে করেছেন ১৬ গোল। লিগে গোল ১৪টি।

আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার লাওতারো মার্তিনেজ।
ছবি: টুইটার

ড্যানি ইংস (ইংল্যান্ড, সাউদাম্পটন)

ম্যানচেস্টার সিটির বর্তমান মালিক দায়িত্ব নেওয়ার পর দলটা কখনো নিজের দেশ থেকেই স্ট্রাইকার কেনেনি। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, স্পেন, সার্বিয়া, ইতালি, এমনকি বসনিয়া থেকে স্ট্রাইকার এলেও ইংলিশ কোনো স্ট্রাইকারকে পছন্দ হয়নি সিটির কোনো কোচের।

গত এক যুগে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ওয়েইন রুনি, ড্যানিয়েল স্টারিজ, পিটার ক্রাউচ, জার্মেইন ডেফো, অ্যান্ডি ক্যারল, রিকি ল্যামবার্ট, হ্যারি কেইন, মার্কাস রাশফোর্ড, জেমি ভার্ডিসহ অনেক স্ট্রাইকার। কেউই সিটির নতুন মালিক আসার পর আকাশি জার্সি গায়ে তোলেননি। এবার সে ধারার ব্যত্যয় ঘটতে পারে। দলে আসতে পারেন সাউদাম্পটনের স্ট্রাইকার ড্যানি ইংস।

সাউদাম্পটনের স্ট্রাইকার ড্যানি ইংস।
ছবি: টুইটার

গত কয়েক মৌসুম ধরেই লিগ টেবিলের মাঝ সারির এই ক্লাবের আক্রমণভাগ গড়ে উঠেছে তাঁকে ঘিরে। গত মৌসুমে লিগে ২২ গোল করা স্ট্রাইকার এবার গোল করেছেন ৮টি। গোল সহায়তাতেও বেশ ভালোই ভূমিকা রাখতে পারেন ২৮ বছর বয়সী লিভারপুলের সাবেক এই স্ট্রাইকার।

ইংল্যান্ডের ঘরের ছেলে, ইংল্যান্ডের একাডেমিতে বেড়ে উঠেছেন, ফলে ইংসকে দলে নিলে ‘হোম গ্রোন’ কোটায় সিটির সুবিধাও হবে একটু। সাউদাম্পটনের সঙ্গে এখনো চুক্তি নবায়ন করেননি ইংস। সিটি যদি আসলেই তাঁকে চায়, তবে চুক্তি নবায়ন না করলে সিটিরই লাভ।

হ্যারি কেইন (ইংল্যান্ড, টটেনহাম হটস্পার)

২০০৯ সাল থেকে টটেনহামে খেলে যাচ্ছেন, ১৬০ গোল করে লিগের ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। কিন্তু এত কিছু করার পরও হ্যারি কেইনের অর্জনের ভাঁড়ার শূন্য। প্রায় এক যুগ ধরে ট্রফি জেতে না টটেনহাম। আর এই ট্রফি জয়ের আশাতেই হয়তো এই মৌসুমের পর শৈশবের প্রিয় টটেনহাম ছেড়ে সিটিতে নাম লেখাতে পারেন ইংলিশ অধিনায়ক।

টটেনহাম তারকা হ্যারি কেইন।
ছবি: টু্ইটার

তবে কেইনকে দলে আনার প্রক্রিয়াটা অত বেশি সুবিধার হবে না সিটির জন্য। কারণ আর কিছুই নয়, টটেনহামের সভাপতি ড্যানিয়েল লেভি। দলবদলের সময়ে খেলোয়াড়ের দাম নিয়ে এই ভদ্রলোক যেভাবে দামাদামি করেন, তাতে আগ্রহী ক্লাবের আগ্রহ এমনিতেই কমে যায়। এমনিতেই লেভি জানিয়ে দিয়েছেন, কেইনকে পেতে চাইলে ২০ কোটি পাউন্ড খসানো লাগবে, নয়তো কোনো কথা নেই।

অবশ্য প্রশ্ন যেখানে আগুয়েরোর বিকল্প খোঁজা, সেখানে বিকল্পের নাম হরলান্ড হোক বা লুকাকু-কেইন হোক—স্ট্রাইকার আনতে সিটির গলদঘর্ম তো হবেই!