সীমাহীন ভালোবাসা আর বাঁধনহারা জীবনের ৬০ বছর

ম্যারাডোনা—আর্জেন্টাইনদের ভালোবাসার নাম।ছবি: রয়টার্স

লোকচক্ষুর অন্তরাল যাকে বলে, ঠিক সেভাবেই কাটছে তাঁর ৬০তম জন্মদিনটা।

না, নতুন করে কোনো বিতর্কের জন্ম-টন্ম দিয়ে আড়ালে চলে যাননি ডিয়েগো ম্যারাডোনা! তাঁর কথা বলা হচ্ছে শুনে অনেকের মনে সবার আগে বিতর্কের সম্ভাবনার কথাই আসতে পারে। তবে ম্যারাডোনা এবারের জন্মদিনটা একেবারে ‘গৃহবন্দী’র মতো পালন করছেন। সময়টাই যে এমন! তাঁর এক দেহরক্ষীর শরীরে করোনার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। গত ২০ বছরে দুবার হার্ট অ্যাটাক করা, হেপাটাইটিসে ভোগা আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি সতর্কতার জন্যই তাই আইসোলেশনে চলে গেছেন।

ঘরে বসে আজ জন্মদিনটা কীভাবে পালন করছেন তিনি, কে জানে! এতটুকু নিশ্চিত, বাঁধনহারা এক জীবনের সঙ্গে একেবারেই মিলছে না ম্যারাডোনার ৬০তম জন্মদিনের উৎসব। যে জীবনে খ্যাতি আর বিতর্কে হাত ধরাধরি। যে জীবন তাঁর প্রতি সাধারণের ভালোবাসায় সীমা মানতে দেখেনি, মাত্রা মানতে দেখেনি কোকেন-অ্যালকোহলের প্রতি তাঁর আসক্তিতে। যে জীবনে ফুটবল তাঁর প্রতিভাকে ভাসিয়েছে পুরস্কারে পুরস্কারে, ফুটবলের বাইরের জগৎটা তাঁকে টেনেছে অতল অন্ধকারে। অসীম অর্জন আর বাধঁনহারা উদ্‌যাপনের ৬০ বছর পূর্তি আজ।

‘এই ছেলেটা এত ভালো করবে, এটা ভাবাই অসম্ভব ছিল’—এ বছরের শুরুর দিকে কথাটা বলেছিলেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দল ও ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে ম্যারাডোনার সাবেক সতীর্থ উগো পেরোত্তি। তাঁর ইঙ্গিত ছিল ক্যারিয়ারের শুরুতেই ম্যারাডোনার খ্যাতি আর সাফল্যের পাহাড় চড়ার দিকে। পাহাড়ের চূড়ায় গেছেন বটে, ম্যারাডোনা সাফল্য ছুঁয়েছেন সবখানে। কিন্তু চূড়া থেকে পতনেও সময় লাগেনি। ম্যারাডোনার ভাগ্য ভালো, ফুটবলটা বারবার তাঁর ডানা হয়ে এসেছে। যতবারই পতন দেখেছেন, ফুটবলের ডানায় চড়ে উঠে এসেছেন বারবার।

হয়তো এত উত্থান-পতন আছে বলেই তাঁর জীবন এত ক্যারিশম্যাটিক। হৃৎপিন্ডের বহমানতার মতো উত্থান-পতন আছে বলেই হয়তো জায়গা করে নিতে পেরেছেন মানুষের হৃদয়ে।

ম্যারাডোনা অকপট, কোনো ছল-ছাতুরি সেখানে নেই। ম্যারাডোনা জেদিও। পৌরুষদীপ্ত একটা তেজ আছে তাঁর। বন্ধুত্বের প্রশ্নে তিনি বিশ্বস্ত, শত্রুতায় বিদ্বেষপূর্ণ। সব মিলিয়ে ম্যারাডোনা সম্মোহনী। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েনস এইরেসের দরিদ্র অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার সেই সম্মোহন আর্জেন্টিনার অলিগলি হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়াতে তাই সময় লাগেনি। ‘১৮ বছর বয়সের সময় ও আফ্রিকার রাস্তায় হাঁটতে পারত না। একবার একটা প্লেন আটকে গিয়েছিল, কারণ রানওয়েতে ওর ভক্তরা জড়ো হয়ে ছিল। সময়টা ছিল ১৯৮১ সালে। তখন কোনো ইন্টারনেট ছিল না, ছিল না মুঠোফোন বা এমন কিছু।’—পেরোত্তির স্মৃতিচারণ।

সাধারণের এই নিষ্পাপ ভালোবাসা আর তাঁর খ্যাতির কথাগুলো বলতে গিয়ে যদি-বা একটু উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন পেরোত্তি, পরমুহূর্তে সেটি মিলিয়ে যায়, ‘আমার মনে হয় পরে এগুলোরই মূল্য দিয়েছে ও।’

পতনের আগে উত্থানটাও তো ছিল দেখার মতো! বোকা জুনিয়র্সকে আর্জেন্টাইন লিগ জিতিয়ে ২১ বছর বয়সে ম্যারাডোনা যোগ দেন বার্সেলোনায়। ২৫ বছর বয়সে মেক্সিকোতে বলতে গেলে একাই আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। তাঁর এক জীবন রাঙানো সেই অর্জনের পথে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যারাডোনার প্রতিভা ও ম্যারাডোনার দুষ্টুমি—দুই রূপই দেখিয়ে গেল। আর্জেন্টিনার ২-১ গোলে জয়ের পথে সেদিন দুই গোলই তাঁর। প্রথমটি বাঁ হাতের টোকায়, যেটিকে ম্যারাডোনা নিজেই পরে নাম দিয়েছেন ‘হ্যান্ড অব গড’। পরেরটি বাঁ পায়ের চোখধাঁধানো ঝলকে, মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ছয়জনকে কাটিয়ে, ইংল্যান্ডের মাঝমাঠ-রক্ষণের পর গোলকিপারকে ঘোল খাইয়ে!

আর্জেন্টাইনরা অবশ্য তাঁর প্রথম গোলটিকেও গর্বের চোখেই দেখে। তাঁদের চোখে সেটি হয়তো যেকোনো মূল্যে আর্জেন্টিনার জয় নিশ্চিত করতে চাওয়ার বাসনারই প্রতিফলন। সেটি নিয়ে বিতর্ক তো দূরের ব্যাপার, বিশ্বকাপ জেতার পরে তাই ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনায় হয়ে গেলেন ফুটবল ঈশ্বর! কতটা অতি-উৎসাহী তাঁর ভক্তরা, তার প্রমাণ এই যে, ম্যারাডোনার নামে একটা চার্চও প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা!

আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর ক্লাব নাপোলির হয়ে ম্যারাডোনার জয়গাথা লেখার শুরু। তিন বছরে দুবার লিগ জিতিয়েছেন, এখন পর্যন্ত নাপোলির ইতিহাসে লিগ শিরোপা সেই দুটিই। কিন্তু চারিদিকে এত সাফল্যের জয়গানের মাঝে ম্যারাডোনার পতনের সুরও ভাসতে থাকে আড়ালে। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ছন্নছাড়া আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েও বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি, ম্যারাডোনার কান্না সেদিন ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁর ভক্তদের মন। পরের বছর নাপোলিতেও তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল অপমানে। কোকেন নেওয়ার দায়ে ১৫ মাস নিষিদ্ধ হন ম্যারাডোনা। গুঞ্জন আছে, কোকেন নেওয়ার অভ্যাসটা বার্সেলোনায় থাকার সময় থেকেই শুরু হয়েছে তাঁর।

এরপর তো ১৯৯৪ বিশ্বকাপের সেই অপমানে বাড়ি ফেরা! নাপোলিতে পাওয়া নিষেধাজ্ঞার পর ওই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা কিছু করে দেখাবেন বলে ভাবা হচ্ছিল, কিন্তু ডোপ টেস্টে ব্যর্থ হয়ে গ্রুপ পর্বেই টুর্নামেন্ট থেকে নিষিদ্ধ হয়ে বাড়ি ফেরেন আর্জেন্টাইন কিংবন্তি। অভিযোগের সুরে পরে বলেছিলেন, ‘ওরা যেন আমার পা কেটে ফেলেছে!’ এরপর বোকা জুনিয়র্সে বছর দুয়েক খেলেছেন বটে, তবে ম্যারাডোনার ক্যারিয়ার ১৯৯৪ বিশ্বকাপেই মূলত শেষ হয়ে গেছে! ২১ বছর, ৬৭৯ ম্যাচ, ৩৪৬ গোল, কিছু শিরোপা আর শতসহস্র চোখধাঁধানো মুহূর্ত উপহার দেওয়া এক ক্যারিয়ার।

ম্যারাডোনা এখন জিমনাসিয়া দে লা প্লাতার কোচ।
রয়টার্স ফাইল ছবি

কোচিংয়ে এসে ম্যারাডোনা কখনো সফল হবেন, এমন কল্পনা করা মানুষের সংখ্যাই খুব কম ছিল। কল্পনাকে হার মানানো কিছু ঘটেওনি। আবেগী আর্জেন্টাইনরা ২০০৮ সালে কোচিংয়ে আনকোরা ম্যারাডোনার হাতে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল বটে! পরিকল্পনার চেয়ে যেটিতে বেশি ছাপ অবাস্তব কল্পনার। দলে মেসি আছেন, ডাগআউটে ম্যারাডোনা—বিশ্বকাপ এবার আর ঠেকায় কে, এমন কিছুই হয়তো ছিল ভাবনা। হলো কী? কাঁচকলা! কোনোরকমে দলকে বিশ্বকাপে ওঠানোর পর কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়ে বিদায় ম্যারাডোনা-মেসির আর্জেন্টিনার।

নামটা ম্যারাডোনা বলেই এরপরও এখানে-সেখানে কোচিংয়ের ডাক পেয়েছেন। সেসবের পেছনে তাঁর কোচিংয়ে ভরসার চেয়েও ম্যারাডোনা নামের বাণিজ্যিক আবেদনেরই বেশি প্রভাব ছিল বলে অনুমান। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকো কিংবা নিজ দেশ আর্জেন্টিনায় সেসব কোচিং ‘ক্যামিও’তে সব জায়গাতেই ব্যর্থ ম্যারাডোনা। এখন ম্যারাডোনা আর্জেন্টাইন ক্লাব জিমনাসিয়া দে লা প্লাতার কোচ।

তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারে তো বটেই, ১৯৯৭ সালে খেলা ছাড়ার পর ম্যারাডোনার জীবনে বারবার হানা দিয়েছে স্বাস্থ্যগত নানা ঝামেলা, বেশিরভাগই নিজের দোষে। ২০০০ সালে প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হলো তাঁর, চার বছর পর আবার। তখন মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার ম্যারাডোনার ওজন ছিল ১০০ কেজিরও বেশি! অতিমাত্রায় অ্যালকোহল পানের কারণে ২০০৭ সালে দুবার তাঁকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। ম্যারাডোনা সে সব যে বুঝতেন না, তা নয়। বুঝতেন, কিন্তু মানতেন না। ২০০১ সালে বোকা জুনিয়র্সের মাঠ বোমবোনেরায় ভরা গ্যালারির সামনে এক অনুষ্ঠানে ম্যারাডোনাই বলেছিলেন, ‘ক্যারিয়ারজুড়ে আমি অনেক ভুল করেছি, সেগুলোর মূল্যও দিয়েছি। তবে ফুটবলটাতে কখনো কাদা লেগে থাকতে দিইনি।’

তারপরও বারবার বিতর্কে জড়িয়েছে তাঁর নাম। এখনো মাঝে মাঝে গুঞ্জন ওঠে, অ্যালকোহল-কোকেনে এখনো আসক্ত আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। বিতর্কে এসেছেন এর বাইরে নানা কারণেও। কখনো পশ্চিমা বিশ্বের রোষে পড়েছেন বামপন্থী লাতিন নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বা উগো শাভেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কারণে। কখনো বা বিতর্কে এসেছেন বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে।

সাবেক স্ত্রী ক্লদিয়া ভিলাফানের সঙ্গে ২৪ বছরের বৈবাহিক জীবনে ম্যারাডোনার শুধু দালমা ও জিয়ান্নিনা নামে দুই মেয়ে আছে বলেই শোনা গেছে অনেকদিন। কিন্তু ভিলাফানের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ইতালি, কিউবা ও আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনার আরও অন্তত পাঁচ সন্তানের কথা জানা যায়। সাবেক বান্ধবী ভেরোনিকা ওহেদার সঙ্গে সম্পর্কে ২০১৩ সালে দিয়েগো ফার্নান্দো নামে এক ছেলের জন্ম হয়েছে বলেও জানা যায়। ভিলাফানে তখন ইনস্টাগ্রামে শ্লেষাত্মক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘আর তিনটি সন্তান হলেই ১১ জনের একটা দল হয়ে যাবে তোমার। আমি জানি তুমি সেটা করতে পারবে।’

এখনো ওই আট সন্তানের বাইরে আর কারও কথা জানা যায়নি। তবে জানা গেলেও হয়তো অবাক হওয়ার থাকবে না। ম্যারাডোনা যে এমনই! বেখেয়ালি, বেপরোয়া। সীমা মানায় যাঁর নিরন্তর আপত্তি।

বাঁধনহারা সেই জীবনের ৬০ বছর পূর্তিতে শুভেচ্ছা, ম্যারাডোনা। শুভ জন্মদিন।