সুরম্য বাফুফে ভবন, ভেতরে 'সদরঘাট'

প্রশাসকদের জন্য সুরম্য ভবন থাকলেও দেশের ফুটবলটা বড় দৈন্যই। ছবি: প্রথম আলো
প্রশাসকদের জন্য সুরম্য ভবন থাকলেও দেশের ফুটবলটা বড় দৈন্যই। ছবি: প্রথম আলো
আমাদের প্রাণের খেলা ফুটবল আজ গভীর সংকটে। অন্তত তিন বছরের জন্য নির্বাসনে চলে যেতে হলো বাংলাদেশ জাতীয় দলকে। কেন এই দশা? কোনো আশা কি আছে বাকি? ২০ বছর ধরে একদম কাছ থেকে দেশের ফুটবলকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি মাসুদ আলমের পাঁচ পর্বের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন। আজ বাফুফের কর্মকর্তাদের দায় নিয়ে তৃতীয় পর্ব

সুরম্য ভবনের সামনে সবুজ চত্বর। দেখতে ভালোই লাগে। দেশের ফুটবলের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ হয় এখান থেকে। এই ভবনে আসা-যাওয়া কত রথী-মহারথীর। বিশ্ব ফুটবল দীর্ঘদিন শাসন করা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেপ ব্ল্যাটারের পর্যন্ত পায়ের ধুলো পড়েছে এই ভবনে। সেটিও বেশ কয়েকবার।

এই ভবন ফুটবলের সুখ-দুঃখ দেখছে এক যুগ হলো। যদি বলা যেত মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় এটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে, তাহলেই বেশি মানানসই হতো। কিন্তু বাফুফে ভবনটা কার্যত এখন মৃত। প্রাণহীন ভুতুড়ে এক জায়গা।
ভুটানের কাছে জাতীয় দলের হার দেখে অলক্ষ্যে ভবনটা বুঝি নিজেকেই প্রশ্ন করে, ‘কী করলে তুমি হে এত দিন!’ সাড়ে আট বছর আগে কাজী সালাউদ্দিনকে বাফুফে সভাপতির চেয়ারে বরণ করে নিলে বিপুলভাবে, বিনিময়ে কী পেলে? কী দিল তোমায় একদল সাবেক তারকা ফুটবলার? বাফুফের নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হয়ে তাঁরা সভায় বসলে আশপাশে খবর হয়ে যায়, বিশাল কিছু হচ্ছে বোধ হয়!। কিন্তু ফুটবল উন্নয়নে তাঁদের খেরোখাতাটা কেমন?
প্রশ্নটা তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে সালাউদ্দিন, সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়দের কাছে, ‘আপনাদের শুরুর সময়ে দেড় শর নিচে থাকা জাতীয় দলের ফিফা র‌্যাঙ্কিং আজ কেন ইতিহাসের সর্বনিম্ন—১৮৫? এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে যেতে না পারার মাশুল গুনে এখন সেটি ২০০-এর ওপাশেও চলে যেতে পারে। আগামী তিন বছর বাংলাদেশের সামনে ফিফা-এএফসির ম্যাচ নেই। আপনারা কোথায় নিয়ে গেলেন ফুটবলটা?’

মাথা নিচু করে রাখবেন দেশের ফুটবলের এই মহারথীরা। তাঁদের ব্যর্থতায় আজ দিশাহীন ফুটবল। নেতা হিসেবে সালাউদ্দিন নানা যুক্তি দিচ্ছেন, তবে সবই অসার মনে হচ্ছে। তিনি তো স্বীকারই করে নিয়েছেন, ‘জাতীয় দল নিয়ে আমার পরিকল্পনা কাজ করেনি।’ অথচ সব বাদ দিয়ে জাতীয় দলের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলেছেন সালাউদ্দিন। কিন্তু এই ফুটবলাররাই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের টানা তিন আসরে গ্রুপ থেকে বিদায় নিয়েছে! তখনই উচিত ছিল নতুন খেলোয়াড় তুলে এনে শক্তিশালী জাতীয় দল গড়া, তা হয়নি। সব হারিয়ে এত দিনে সালাউদ্দিন বলছেন, ‘আগামী তিন বছর তৃণমূল নিয়ে কাজ করব।’ তার মানে এই মৌলিক বিষয়টিই এত দিন অবহেলা করেছেন তাঁরা!

এত দিন না পারলেও সালাউদ্দিন এখন বলছেন পারবেন। সভাপতি হিসেবে আট বছরে যা পারেননি, সেটি তিনি তৃতীয় মেয়াদের বাকি সাড়ে তিন বছরে করে দেখাবেন! তিনি নিজেকে ব্যর্থ মানেন না, তাই পদত্যাগ করবেন না। অথচ তাঁর পদত্যাগ দাবির পেছনে বড় যে যুক্তি, সেই ফুটবলার তুলে না আনার ব্যাপারে বরাবর বলে এসেছেন ওটা ক্লাবের দায়িত্ব। কিন্তু ক্লাব ওটা না করলেও তাদের বাধ্য করেনি। ডেকে কখনো কথা পর্যন্ত বলেননি।
একটা দেশের ফুটবল ভিত্তি গড়তে বয়সভিত্তিক ও জাতীয় টুর্নামেন্টগুলো আবশ্যক। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও ১৫ বছর ধরে শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল বন্ধ! অনূর্ধ্ব-১৯ সোহরাওয়ার্দী কাপ হিমাগারে ঢুকেছে তারও অনেক আগে। অনূর্ধ্ব-১৪ বিমান কাপেরও একই অবস্থা। জাপান ফুটবল ফেডারেশনের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল দুই বার হয়েই বন্ধ। ফুটবলার ছেঁকে তুলে আনার সূতিকাগার স্কুল ফুটবল চরম উদাসীনতার শিকার। পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ হয়েছে এটি। খেলোয়াড় তুলে আনতে এত বছরে একটা একাডেমি করেও চালু রাখা যায়নি ১২ মাসও।
বাফুফের নির্বাচনে তাস হয়ে ওঠা ‘ঢাকার বাইরের ফুটবলের’ হালচালই-বা কী? কয়েকটি বাদে বাকি জেলাগুলোয় লিগ অনিয়মিত। লিগের খোলসে বেশির ভাগ জেলাতেই হয় আসলে টুর্নামেন্ট! চার-পাঁচটা ম্যাচেই শেষ! বাফুফে এসব জেনেও চুপ। কারণ, ভোটের সময় জেলাগুলোকে যে লাগে!

ফুটবলের অধোগতির জন্য বাফুফের অনেকে দায়ী করেন জেলা ফুটবল সংস্থা বা ডিএফএকে। ২০০৮ নির্বাচনের আগে ফিফার ব্যবস্থাপনায় গঠিত জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিএএ) হয়ে আছে ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে (ডিএসএ) থাকা মাঠ নাকি পায় না ডিএফএ। এসব ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সালাউদ্দিন এই কয়েক বছরে জেলাগুলোতে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন। এটা যৎসামান্য টাকাই। কিন্তু ডিএফএগুলো সক্রিয় না হওয়ায় তৃণমূলে আগের মতো লিগ নেই। ডিএফএর বিকল্প সন্ধানে নির্বাচনে আগে ফেডারেশনের তিন কর্মকর্তা সুইজারল্যান্ডে ফিফার দরবার ঘুরে এলেন, কিন্তু সেটার আর কোনো খবর নেই।
থাকবে কী করে? বাফুফে দুটি স্রোতে বিভক্ত। সালাউদ্দিন ও তাঁর অনুগামী কয়েকজন একপাশে। অন্যদিকে বাদল রায়, হারুনুর রশিদরা। তবে বাদল রায়রা বলেন, ‘আমরা তো সভাপতির বিরুদ্ধে নই।’ বরং সভাপতি সব একক সিদ্ধান্তে করেন বলে অভিযোগ তাঁদের। যদিও গঠনতন্ত্রই সভাপতিকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। সালাউদ্দিনের সমর্থকেরা পাল্টা দেন, সভাপতির কাজে নাকি এই পক্ষ বাধা দেয়! তবে বাফুফে ভবনে নিয়মিত যাওয়ার সুবাদে সালাউদ্দিনকে কেউ কোনো কাজে বাধা দিয়েছেন, এমনটা দেখা যায়নি। অনেক বরং রসিকতা করেন, ফুটবলের কমিটি সাবেক খেলোয়াড়ে ঠাসা তো, অধিক সন্ন্যাসী গাজন নষ্ট!

লিগ কমিটির সভাপতি হিসেবে সালাম মুর্শেদীর অনেক সিদ্ধান্তই মানে না ক্লাব। তাই ক্লাবের কথামতোই সব করেন ‘নরম’ মনের সালাম, বারবার খেলা পেছান। ক্লাবগুলোর যুব টুর্নামেন্ট বাধ্যতামূলক করেও দুটির বেশি করতে পারেননি। লিগ চ্যাম্পিয়ন শেখ জামাল দুবারই খেলেনি এবং তাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি ফেডারেশন। অতীতের মতো প্রতিষ্ঠানটি মেরুদণ্ডহীন রয়ে গেছে। কোনো কিছুর ঠিক নেই।
ঢাকার দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ লিগে ধারাবাহিকতার বড়ই অভাব। অনূর্ধ্ব-১৪ পাইওনিয়ার লিগেরও একই অবস্থা। সালাউদ্দিন-যুগের বড় সমস্যা এটাই। তিনি হঠাৎ চমক দেন। চ্যাম্পিয়ন দলকে কোটি টাকা দিয়ে যেমন হঠাৎ শুরু করলেন সুপার কাপ। টুর্নামেন্টটা ভালোই জমেছিল। তৃতীয়বার শুধু স্থানীয় খেলোয়াড় দারুণ সফল। কিন্তু এরপর এটিও শেষ। সারা দেশের ক্লাব নিয়ে ‘ক্লাব কাপ’ও একবার করেই ইতি। বঙ্গবন্ধু কাপ দুবার করে এবার আর হচ্ছে না ‌দল পাওয়া যাচ্ছে না কারণ দেখিয়ে। চট্টগ্রাম আবাহনী গত বছর এই সময়ে চট্টগ্রামে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করেছিল, সম্ভবত এটিও শেষ দেখে ফেলেছে!
সবকিছু নিয়মিত মাঠে থাকলে তবেই না ফল পাবে জাতীয় দল। অথচ সেটি হচ্ছে কই! বাফুফের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান বাদল রায় বলছেন,‘ আর সব বাদই দিলাম, একাডেমির মৃত্যু সত্যিই দুঃখজনক। তৃণমূলে কাজ করতে টাকা চেয়েও পাইনি। আজ পর্যন্ত একটা নীতিমালা হলো না। ফুটবল কীভাবে এগোবে। রোডম্যাপ কী?

প্রিমিয়ার লিগ নিয়মিত হওয়ার ব্যাপারটা সামনে আনেন সালাউদ্দিন। লিগ তো সব দেশেই হয়। উন্নয়নমূলক কাজটাই আসল। আর এখানেই মেয়েদের ফুটবলে ভালোই উন্নয়ন হয়েছে, সম্প্রতি এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বিভাগে এশিয়ার সেরা আটে গিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। ছেলেরা ২০১০ ঢাকা এসএ গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কাপে হয়েছে রানার্সআপ।
কিন্তু আজ আর এসব কে মনে রাখে! ভুটান-লজ্জায় আজ সবই মলিন। যে লক্ষ্য নিয়ে একঝাঁক সাবেকসহ ফেডারেশনের নেতৃত্বে এলেন সালাউদ্দিন, তা পূরণ হয়নি। প্রত্যাশার বেলুনটা বড্ড ফুটো!

আগামীকাল পড়ুন যায়, ফুটবলে প্রতিভা আছে, যত্নের অভাবে হারিয়ে যায়...