সুয়ারেজকে ছাড়া মেসিরা খেলতে পারেন যেভাবে...

সুয়ারেজ চলে গেছেন আতলেতিকোয়, বার্সার বড় দুই ভরসা এখন গ্রিজমান-মেসি।ছবি: এএফপি

গতকাল শেষ হলো লুইস সুয়ারেজের বার্সা-ক্যারিয়ার। যবনিকা ঘটল এক অধ্যায়ের। লুইস এনরিকে থেকে শুরু করে আর্নেস্তো ভালভার্দে, কিকে সেতিয়েন—বার্সার কোচ যাঁরাই হয়েছেন, মূল একাদশে কে কে খেলবেন সে তালিকা করতে বসলে আক্রমণভাগে মেসির পাশে সুয়ারেজের নামটাই লিখে গেছেন এত দিন ধরে।

সে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে নতুন কোচ রোনাল্ড কোমান যাবেন না, আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সুয়ারেজের বিদায় সেই কারণেই। এর মধ্যে লিগ প্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো মাদ্রিদে যোগ দিয়েছেন এই উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার। সেখানে দিয়েগো কস্তা, জোয়াও ফেলিক্সের সঙ্গে সফল একটা আক্রমণভাগ গড়বেন, লিগ জয়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করবেন—আতলেতিকো ভক্তদের আশা সেটাই।

কিন্তু বার্সেলোনার কী হবে? সুয়ারেজহীন বার্সার আক্রমণভাগ কীভাবে সাজাবেন নতুন কোচ কোমান? বাকি দলের কৌশলই বা কেমন হবে?

গত তেত্রিশ বছরে বার্সেলোনার কোচ যাঁরা হয়েছেন, তিনজন (যুগোস্লাভিয়ার রাদোমির আন্তিচ, ইংল্যান্ডের ববি রবসন ও আর্জেন্টিনার জেরার্দো মার্তিনো) বাদে প্রত্যেকেই হয় বার্সার ঘরের ছেলে, নয়তো সত্তরের দশকের সেই বিখ্যাত ডাচ বিপ্লব—‘টোটাল ফুটবলে’ অনুপ্রাণিত। ‘টোটাল ফুটবল’-এর বিপ্লব যাঁদের হাতে শুরু হয়েছিল, তাঁদেরই একজন ইয়োহান ক্রুইফ এসে ক্লাবের খোলনলচেই বদলে দিয়ে গেছেন। সৃষ্টি করেছেন লা মাসিয়া। সে লা মাসিয়ায় বেড়ে ওঠা পেপ গার্দিওলা পরে হয়েছেন বার্সার সফলতম কোচ।

বার্সেলোনা ক্লাব ও তাঁর সমর্থকদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার পেছনে গার্দিওলার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। ক্লাব ইতিহাসের সবচেয়ে সফল সময়টা যে এই গার্দিওলার অধীনেই কাটিয়েছে বার্সা! এক মৌসুমে ছয় শিরোপার সবগুলো জেতার কৃতিত্বও গড়েছে। ‘টিকি-টাকা’ ফুটবলকে বৈশ্বিক ‘ব্র্যান্ড’ বানানোর পাশাপাশি গার্দিওলার বার্সা বিশ্বকে দেখিয়েছে, কীভাবে আক্রমণাত্মক ও সুন্দর ফুটবল খেলে একের পর এক শিরোপা জেতা যায়। ফলে যে জিনিসটা হয়েছে, বার্সেলোনার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এই ধারণাটা গেড়ে বসেছে, এক যুগ আগে গার্দিওলা যে ধরনের ফুটবল খেলিয়ে দলকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, সে ফুটবল খেলে এই ২০২০ সালেও সফল হওয়া সম্ভব। নিজেদের সাবেক খেলোয়াড় রোনাল্ড কোমানকে নিয়োগ দেওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে ওই চিন্তাটাই। হাজার হোক, কোমান ঘরের ছেলে তো!

কিন্তু নিয়ত পরিবর্তনশীল এই ফুটবলে অতীতের আশ্রয়ে থেকে নিয়মিত সফল হওয়া যায় না। গার্দিওলা নিজেও থাকেননি। বার্সার পর বায়ার্ন মিউনিখ, বায়ার্নের পর এখন ম্যানচেস্টার সিটি—প্রতিটি জায়গায় নিজেকে একটু একটু করে বদলেছেন, ক্রমশ পরিবর্তনশীল আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে নিজেকে রেখেছেন প্রাসঙ্গিক।

ব্যাপারটা কোমান বেশ ভালো জানেন। জানেন বলেই ক্লাবে আসার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছেন, পুরোনো দিনের যোদ্ধাদের দিয়ে আগে অনেক কিছু জেতা গেলেও, এখন তা সম্ভব নয়। সময় এখন নতুন কৌশল, নতুন খেলোয়াড়, নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার। সুয়ারেজের বিদায়টা সেই উপলব্ধিরই ফসল। তার আগে বিদায় জানিয়েছেন আর্তুরো ভিদাল, ইভান রাকিতিচদের। জর্দি আলবা, জেরার্ড পিকে কিংবা সের্হিও বুসকেতসদের জানিয়ে দিয়েছেন, মূল একাদশে আর তাঁদের জায়গা পাকা নয়। বুড়ো ঘোড়া নয়, দলকে টগবগিয়ে ছুটতে হবে তরুণ কাঁধে ভর করে।

তারুণ্যে আস্থা রাখার পাশাপাশি কোমান আরেক জায়গায়ও পরিবর্তন আনতে চলেছেন। অন্তত তাঁর অধীনে তিনটি প্রীতি ম্যাচ দেখে সেটাই মনে হয়েছে। এর আগে বার্সেলোনা আর ৪-৩-৩ ছক যেন একরকম হরিহর আত্মা ছিল। গার্দিওলা এই ছক অনুসরণ করেই সাফল্য পেয়েছেন। মাঝে জেরার্দো মার্তিনো, লুইস এনরিকে, আর্নেস্তো ভালভার্দে বা কিকে সেতিয়েনরা অন্যান্য ছক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেও শেষমেশ ওই ৪-৩-৩ ছকেই থিতু হয়েছিলেন সবাই।

কোমান হয়তো ৪-৩-৩ থেকে আস্তে আস্তে সরে আসবেন। তিন প্রীতি ম্যাচেই দলকে ৪-২-৩-১ এ খেলিয়েছেন বার্সা। সবার ওপরে হয় মেসি খেলেছেন, নয় গ্রিজমান। ওপরে মেসি খেললে তাঁর ভূমিকাটা হয়ে যায় ‘ফলস নাইন’—স্ট্রাইকার হয়েও স্ট্রাইকার নন, গোল করার পাশাপাশি বানানোতেও মনোযোগ। গার্দিওলার অধীনে এই পজিশনে খেলেই বিশ্বসেরা হয়েছিলে মেসি। গত কয়েক বছর ধরে রাইট উইঙে খেলা মেসিকে আবারও সে পজিশনে ফিরিয়ে এনে সাফল্য ধরতে চাইবেন কোমান।

মেসি ওপরে খেললে ডানে থাকবেন গ্রিজমান। আবার গ্রিজমান ওপরে থাকলে মেসি থাকবেন ডানে। তাঁদের দুজনের মধ্যে জায়গার অদলবদল হবে প্রতিনিয়ত। আরেক উইংয়ে দেখা যেতে পারে পুরোপুরি তারুণ্যের আবাহন—ওসমানে দেম্বেলে, আনসু ফাতি কিংবা ফ্রান্সসিকো ত্রিনকাওকে এই কয় ম্যাচে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলিয়েছেন কোমান।

তবে নতুন একজন স্ট্রাইকার দলে আসছেন, সেটা নিশ্চিত। লিওঁর ডাচ তারকা মেম্ফিস ডিপাইকে পছন্দ কোমানের, এ আগের খবর। ডিপাই বার্সায় গেলে স্ট্রাইকার হিসেবেও যেমন খেলতে পারবেন, খেলতে পারবেন উইঙ্গার হিসেবেও। ছক যদি ৪-২-৩-১ তে বদলানো না-ও হয়, সে ক্ষেত্রে ৪-৩-৩ ছকেও একই খেলোয়াড়দের দেখা যাবে হয়তো। সামনে ‘ফলস নাইন’ হিসেবে মেসি, তাঁর একপাশে গ্রিজমান, আরেক পাশে ফাতি– দেম্বেলে বা ত্রিনকাও।

কোমানের বার্সায় বড় দায়িত্ব থাকবে ব্রাজিল তারকা ফিলিপ কুতিনিওর, আগেই জানা গিয়েছিল। ৪-২-৩-১ ছকে স্ট্রাইকারের পেছনে ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে, কিংবা ৪-৩-৩ ছকে আগে ইনিয়েস্তা যেখানে খেলতেন, সেখানে। অর্থাৎ তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মিডফিল্ডারের ভূমিকায়। তবে এখানেও বার্সাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে ৪-২-৩-১ ছক। কুতিনিও প্রথাগত আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার, এর আগে বার্সার জার্সিতে ৪-৩-৩ ছকে খেলতে সমস্যা হতো তাঁর। ৪-২-৩-১ ছকে সে সমস্যা নেই, স্ট্রাইকারের পেছনে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে সহজাত খেলা খেলতে পারবেন ব্রাজিলিয়ান প্লেমেকার।

কোমান আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর বার্সার অন্যতম প্রধান অংশ হবেন প্রিয় শিষ্য ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং। আয়াক্স থেকে গত মৌসুমে দলে আসা এই তারকা সের্হিও বুসকেতস এর জন্য নিজের পছন্দের (সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার) জায়গায় নিয়মিত খেলতে পারেননি। ৩ মিডফিল্ডারের মধ্যে বাঁ দিকে খেলতেন। তখন ডি ইয়ংদের জাতীয় দল নেদারল্যান্ডসের দায়িত্বে ছিলেন কোমান, যাঁর কাছে ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগত না।

৪-২-৩-১ ছকে খেললে মাঝমাঠের দুজনের একজন নিশ্চিতভাবেই ডি ইয়ং হচ্ছেন। অন্যজন হতে পারেন বুসকেতস, কিংবা সে জায়গার জন্য তাঁর সঙ্গে লড়াই হতে পারে মিরালেম পিয়ানিচ, কার্লেস আলেনিয়া কিংবা নতুন আসা কোনো মিডফিল্ডারের। এ জায়গায় লিভারপুলের ডাচ তারকা জর্জিনিও ভাইনালদামকে পছন্দ কোমানের। যদিও ভাইনালদামের লিভারপুল ছাড়া নিয়ে সংশয় আছে।

কোমানের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা যথারীতি রক্ষণভাগ। কিছুদিন আগে চ্যাম্পিয়নস লিগে যে রক্ষণভাগ বায়ার্ন মিউনিখের কাছে আট গোল খেয়েছে, সে রক্ষণভাগে উন্নতি আনার জন্য নতুন কাউকে এখনো আনেনি দলটা। ক্লাব ছেড়েছেন রাইটব্যাক নেলসন সেমেদো। পিকে, লংলে, উমতিতি, আলবা, রবার্তো—সবাই–ই ক্লাবে আছেন। ম্যানচেস্টার সিটির সেন্টারব্যাক এরিক গার্সিয়া আর আয়াক্সের রাইটব্যাক সের্জিনো দেস্তকে চাইছে বার্সা।

মোটামুটি এই অবস্থা নিয়েই লিগের লড়াইয়ে আগামীকাল থেকে কোমানের অধীনে মাঠে নামতে যাচ্ছে বার্সেলোনা, ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে, বাংলাদেশ সময় রাত একটায়। সুয়ারেজহীন বার্সার চেহারা কালই ভালো দেখা যাবে!