সেই বায়ার্নকে বাড়ি ফিরিয়ে জ্বলজ্বলে নেইমারদের স্বপ্ন

নেইমার অনেক চেষ্টা করেও গোলবঞ্ছিত হয়েছেন বারবার।ছবি: রয়টার্স

এই দুটি ম্যাচ হওয়া উচিত ছিল ভরা গ্যালারির সামনে। দর্শক আওয়াজে গমগমে গ্যালারি, নাচে-গানে উন্মত্ত দর্শক, প্রতিটি গোলে-আক্রমণে কিংবা ম্যাচের শুরু-শেষে গগনবিদারী চিৎকার...তবেই হয়তো এই দুটি ম্যাচের প্রাপ্য বুঝে পাওয়া হতো। হায়, করোনাভাইরাস!

থমথমে গ্যালারিতে হলেও পিএসজি ও বায়ার্ন মিউনিখের দুই ম্যাচ সম্ভবত এখন পর্যন্ত এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের সেরা দ্বৈরথ হয়ে আছে। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, রোমাঞ্চ, ট্যাকটিকসের খেলা - কী ছিল না! রোমাঞ্চে ঠাসা চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের এই দুই লেগ শেষে শেষ পর্যন্ত হেসেছে নেইমার-এমবাপ্পের পিএসজি।

গত মৌসুমের ফাইনালে যে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে নেইমারদের পিএসজিকে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জেতানোর স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেছে, সেই বায়ার্নকেই এবার কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় করে দিয়ে নেইমাররা দিলেন অনুচ্চার ঘোষণা—আমরা আবার আসছি! সেমিফাইনালে এখন নেইমাররা অপেক্ষায় বরুসিয়া ডর্টমুন্ড আর ম্যানচেস্টার সিটির মধ্যে জয়ী দলের।

কালকের ম্যাচ শেষে জয়, ড্র, হার সবই দেখা হলো পিএসজির। নিজেদের মাঠে কাল দ্বিতীয় লেগে পিএসজি ১-০ গোলে হেরেছে বটে। তাতে দুই লেগ মিলিয়ে ৩-৩ সমতা দুই দলে, কিন্তু প্রতিপক্ষের মাঠে বেশি গোল করার সুবাদে সেমিফাইনালে চলে গেছে পিএসজি।

গত বুধবার বায়ার্নের মাঠে গিয়ে ৩-২ গোলে জিতেছিলেন নেইমাররা। সেটিই যে ব্যবধান গড়ে দেবে, অনুমিতই ছিল। তা-ই হলো। বায়ার্ন গোলকিপার মানুয়েল নয়্যারের কণ্ঠেও কাল ম্যাচ শেষে খেদ, ‘আমরা আজ রাতের পারফরম্যান্সের কারণে বাদ পড়িনি। এখানে ১-০ গোলের জয়টা প্রাপ্যই ছিল। কিন্তু মিউনিখের ফলটাই (প্রথম লেগে ৩-২) ছিল খারাপ। আজকের ম্যাচের আগেই তাই আমরা পিছিয়ে ছিলাম।’

প্রথম লেগে ৩১টা শট নিয়েও বায়ার্ন গোল করেছিল মাত্র দুটি, কাল ১৪ শটে একটি। চোটের কারণে ক্লাবের গোলমেশিন রবার্ট লেভানডফস্কিকে হারানোই কি বায়ার্নের এভাবে বাদ পড়ার কারণ? নয়্যার তা স্বীকার করছেন, আবার করছেনও না, ‘প্রথম লেগে এত এত সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে না পারাটা খুব বিরক্তিকর ছিল। লেভানডফস্কিকে কি আমরা মিস করেছি? আজ যারা খেলতে পারেনি, তাদের সবাইকেই আমরা মিস করেছি। পিএসজির মতো মানসম্পন্ন একটা দলের বিপক্ষে এটা (এত খেলোয়াড়কে না পাওয়া) কঠিন।’ লেভানডফস্কি ছাড়াও উইঙ্গার সার্জ নাব্রিকেও দুই লেগে পায়নি বায়ার্ন।

ম্যাচসেরা নেইমার।
ছবি: চ্যাম্পিয়নস লিগের টুইটার একাউন্ট

এ দুজন যে থাকছেন না, তা তো কাল ম্যাচের আগেই জানত বায়ার্ন। সে কারণেই ম্যাচের আগে বায়ার্ন কোচ হানসি ফ্লিক বলছিলেন, প্যারিসে তাঁরা একটা ‘ছোটখাটো অঘটন’ ঘটাতে চান। হয়নি।

বলের দখলে কিংবা শট নেওয়ায় বায়ার্নই দাপট দেখিয়েছে ম্যাচে, কিন্তু পরিষ্কার সুযোগ বেশি পেয়েছে পিএসজি। নেইমার বেশ কয়েকবার গোলবঞ্চিত হয়েছেন, কখনো নয়্যারের কারণে, তো কখনো বায়ার্নের গোলপোস্টের কারণে। পিএসজির আরেক তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে তো গোলের জন্য এতই মরিয়া ছিলেন যে, মোট ৬ বার অফসাইড হয়েছেন ম্যাচে - যা এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে এক ম্যাচে কোনো খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ।

প্রথম লেগে জয়ের পাশাপাশি প্রতিপক্ষের মাঠে ৩ গোল পেয়ে যাওয়ায় পিএসজি জানত, বায়ার্নের জন্য ফিরে আসাটা সহজ হবে না। অন্তত দুই গোলে জিততে হতো জার্মান চ্যাম্পিয়নদের। তারওপর চোটের কারণে ডিফেন্ডার মারকিনিওস ও প্লেমেকার মার্কো ভেরাত্তিকে পায়নি প্যারিসের ক্লাবটি। পিএসজি কোচ মরিসিও পচেত্তিনো সে কারণে রক্ষণ ঠিক রেখে পাল্টা আক্রমণের নীতিতে গিয়েছিলেন। প্রথম লেগেও অবশ্য এই কৌশলেই খেলিয়েছিলেন দলকে।

বায়ার্নের গোলটি করেছেন চুপো-মোতিং (ডানে)।
ছবি: রয়টার্স

খেলাবেন না-ই বা কেন! বায়ার্ন রক্ষণরেখাটা মাঠের অনেক ওপরে (হাই লাইন ডিফেন্স) রেখে খেলতে পছন্দ করে, আর পিএসজির আছে নেইমারের মতো সৃষ্টিশীল আর এমবাপ্পের মতো বিস্ফোরক একজন। গোলকে যদি কৌশলের একমাত্র ফল মানেন, তাহলে কাল সে কৌশলে ফল আসেনি পিএসজির। তবে বায়ার্নকে ভুগিয়েছে বারবার।

প্রথমার্ধেই চারবার নেইমার গোলের সুযোগ পেয়েছিলেন, এর মধ্যে তিনটি তো গোল হতে হতে বেঁচেছে। বায়ার্ন গোলকিপার নয়্যার দুবার ফেরালেন নেইমারকে, এর মধ্যে একবার পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে এসে রুখেছেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের শট। এরপর তিন মিনিটে দুবার নেইমারের গোলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পোস্ট।

৩৭ মিনিটে নেইমারের দারুণ শট বারের কোণে লেগে ফিরেছে। ৩৯ মিনিটে এমবাপ্পের পাস পেয়ে নেইমার যখন নয়্যারকে এড়িয়ে শট নিয়েছিলেন, সেটি ফিরেছে সাইডপোস্টে লেগে।

এর একটিতে গোল হলেও পিএসজির তখন দুশ্চিন্তার তেমন কিছু থাকত না। কিন্তু হলো কী! ৪০ মিনিটে পিএসজি সমর্থকদের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার শুরু। গোল পেয়ে গেল বায়ার্ন! ডেভিড আলাবার শট ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পিএসজি গোলকিপার কেইলর নাভাস, কিন্তু লাফিয়ে ওঠা ফিরতি বল হেড করে জালে জড়ান এই মৌসুমেই পিএসজি ছেড়ে বায়ার্নে যাওয়া স্ট্রাইকার এরিক ম্যাক্সিম চুপো-মোতিং।

প্রথম লেগেও বায়ার্নের দুই গোলের প্রথমটি মিলিয়ে পিএসজির বিপক্ষে ২ ম্যাচেই ২ গোল ক্যামেরুন ফরোয়ার্ডের, যেখানে গত মৌসুম পর্যন্ত পিএসজির জার্সিতে চ্যাম্পিয়নস লিগে ১০ ম্যাচে গোল করেছিলেন একটি!

বক্সের বাইরে থেকে আলাবার বজ্রগতির শট নাভাস ফিরিয়ে না দিলে প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে যেত বায়ার্ন। তা হয়নি, কিন্তু পিএসজির চাপ তাতে কমেনি। গত এক দশকে চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বের দ্বিতীয় লেগে পিএসজির ধসে পড়ার ইতিহাস তো আর কম নয়। চেলসি, বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড...কে জানে, স্মৃতিগুলো তখন পিএসজি সমর্থকদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছিল কি না।

ম্যাচে তখন একটা গোলই পারত ভাগ্য বদলে দিতে! বায়ার্ন গোল পেলে তা পিএসজির জন্য হতো বড় ধাক্কা, পিএসজি পেলে নেইমারদের স্নায়ু শান্ত হতো। দুই দলই অনেক সুযোগ পেয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আনহেল দি মারিয়ার ক্রসে নেইমার পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ, এমবাপ্পের একটা গোল বাতিল হলো অফসাইডে। এর মধ্যে পিএসজি তাদের লেফটব্যাক আবদু দিয়ালোকে হারায় চোটের কারণে। বায়ার্ন তাই আরও চেপে ধরে পিএসজিকে।

এমবাপ্পে-নেইমারের উপস্থিতির কারণে বায়ার্নের ভয় ঠিকই ছিল, যেকোনো সময় পিএসজি পাল্টা আক্রমণে গোল করে আসতে পারে। কিন্তু তখন আর এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায় ফ্লিকের দলের! গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ীরা তখন তেঁড়েফুঁড়ে আক্রমণে উঠছে, গোল না পেলে তো এমনিতেই বিদায়। সেই গোল আর এল না। দ্বিতীয় লেগে হেরেও তাই সেমিফাইনালে পিএসজি। শেষ বাঁশিকে স্বাগতিক দলের বেঞ্চ স্বাগত জানাল তারস্বর চিৎকারে।

এমবাপ্পে সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি।
ছবি: রয়টার্স

‘হারলেও আমি অনেক খুশি। আমরা গ্রেট একটা দলের বিপক্ষে খেলেছি, ইউরোপের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ওরা। কিন্তু আমরা আবার সেমিফাইনালে উঠেছি’— ফরাসি চ্যানেল আরএমসি স্পোর্তে বললেন নেইমার। এর আগের তিন মৌসুমেই শেষ ষোলোতে বাদ পড়া পিএসজি টানা দ্বিতীয় সেমিফাইনালে, বড় কিছুর স্বপ্ন তো এখন আবার উজ্জ্বল। নেইমার শোনালেন সে স্বপ্নের গান, ‘আমরা এখন সত্যিকারের একটা দল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আমরা পরের রাউন্ডে উঠে গেছি। এখন আমরা আরও বড় কিছুর দিকে তাকাতেই পারি।’

গত মৌসুমে দৃষ্টিটা ‘শুভদৃষ্টি’ হয়নি, নেইমারের হাতে ধরা পিএসজিকে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের ইতিহাসে নিজের নাম জড়ানোর স্বপ্ন। শিরোপামঞ্চে ট্রফিটার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন নতমস্তকে। এবার তার চেয়ে একধাপ ওপরে যেতে পারবেন ব্রাজিলিয়ান পোস্টারবয়?

বলবে সময়!