সেনেগালের কোচ যেন ‘চাক দে ইন্ডিয়া’র সেই শাহরুখ খান

আলিউ সিসে, কবির খান (শাহরুখ খান) ; দুজনের 'মিল' চমকে দেবে!ছবি : সংগৃহীত

ঠিক যেন ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য!


২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া বলিউডের এই সিনেমার মূল উপজীব্য—প্রধান চরিত্র কবির খানের ‘শাপমোচন’। যে চরিত্রে রূপদান করেছিলেন বলিউড তারকা শাহরুখ খান। ভারতের পুরুষ হকি দলের অধিনায়ক কবির খান বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারেননি। আগেই এক গোলে পিছিয়ে থাকা ভারতের ম্যাচ রক্ষার আশা শেষ হয়ে যায় তাতে। ম্যাচ শেষে পাকিস্তানি অধিনায়কের সঙ্গে হারের হতাশায় নুইয়ে পড়া কবিরের সৌজন্যমূলক করমর্দনের ছবিটা ভুল বার্তা দেয় ভারতীয়দের। মনের কোণে পাকিস্তানের প্রতি লুকিয়ে থাকা দরদের কারণেই ইচ্ছা করে পাকিস্তানের কাছে ম্যাচ হেরেছেন, মিডিয়ার এমন সন্দেহে বিধবা মাকে নিয়ে ঘরছাড়া হন তিনি। পরে ভারতের নারী হকি দলের কোচ হয়ে বিশ্বকাপ জিতে দেশের মানুষের চোখে খলনায়ক থেকে আবারও নায়ক হন কবির খান।

‘চাক দে ইন্ডিয়া’ ছবির সেই কবির খানরূপী শাহরুখ
ফাইল ছবি

গত রাতে সেনেগালের আফ্রিকান কাপ অব নেশনস (আফকন) জয় যেন ‘চাক দে ইন্ডিয়া’র কাহিনিকেই মনে করিয়ে দিল। নির্দিষ্ট করে বললে, মনে করিয়ে দিলেন সেনেগালের কোচ আলিউ সিসে। সেনেগালের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তগুলোর সঙ্গে যে ভদ্রলোকের নিত্য পথচলা। সব মিলিয়ে তিনবার আফকনের ফাইনালে উঠেছে সেনেগাল। দুবার ফাইনালে হেরে, গত রাতে নিজেদের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছে পেনাল্টি শুটআউটে মোহাম্মদ সালাহর মিসরকে হারিয়ে। ২০০২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা দলটাকেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই সিসে। ২০০২ আফকনে সেনেগাল প্রথম যেবার ফাইনালে উঠেছিল, পেনাল্টি শুটআউটে ক্যামেরুনের কাছে হেরে শিরোপা-স্বপ্নের সমাধি হয়েছিল। কে মিস করেছিলেন ম্যাচের ভাগ্যনির্ধারণী সেই পেনাল্টি?


সেনেগালের অধিনায়ক আলিউ সিসে!

নিজেদের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছে সেনেগাল
ছবি : এএফপি

না, জাতিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের দিক দিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের ধারেকাছেও থাকবে না সেনেগাল-ক্যামেরুন। তবে শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি মিসের কারণে অধিনায়ক হিসেবে দেশের হয়ে পরম আরাধ্য শিরোপাটাকে হাতছোঁয়া দূরত্বে রেখেও ধরতে না পারার যে কষ্ট, তাতে সেলুলয়েডের কবির খানের সঙ্গে অবশ্যই একবিন্দুতে মিলে যাবেন আলিউ সিসে। সিনেমার শেষে কবির খানের শাপমুক্তি ঘটেছিল কোচ হিসেবে ভারতকে শিরোপা জিতিয়ে, গত রাতে আলিউ সিসের শাপমুক্তি হলো একইভাবে, সেনেগালকে ইতিহাসের প্রথম শিরোপা এনে দিয়ে!

গুরুকে নিয়ে শিষ্যদের উল্লাস
ছবি : এএফপি

অবশ্য একদিক দিয়ে চিন্তা করলে পর্দার কবির খানের চেয়ে সিসের কষ্টের ব্যাপ্তি আরও বেশি। কবির খান তো তা–ও কোচ হিসেবে প্রথমবারের প্রচেষ্টাতেই ভারতের মেয়েদের শিরোপা জিতিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে সেনেগাল কোচের দায়িত্ব পাওয়া সিসের শিরোপা এল তিনবারের চেষ্টায়। এর মধ্যে গতবার তো ফাইনালেই হেরেছিলেন। সাদিও মানে, ইদ্রিসা গে, ইসমাইলা সারের প্রতিভাবান সেই দল দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলেও গোলের হিসেবে পেরে ওঠেনি রিয়াদ মাহরেজের আলজেরিয়ার কাছে। দুই মিনিটেই বাগদাদ বোনেদজাহের গোলে পিছিয়ে পড়া সেনেগাল বাকি সময়টা আলজেরিয়ার ডি–বক্সের আশপাশে মাথা কুটে মরেছে গোলের আশায়। পায়নি। ২০০২ সালে পেনাল্টি মিস করে শোকসাগরে ভাসা সিসের ১৭ বছন পরও সঙ্গী হয়েছিল দুই চোখের নোনাজল।

গতবার এভাবেই দূর থেকে শিরোপাকে চলে যেতে দেখেছিল সেনেগাল
ছবি : টুইটার

যে নোনাজল মুছে নেওয়ার দায়িত্ব গত রাতে আবারও নিয়েছিলেন দলের সবচেয়ে বড় তারকা সাদিও মানে। সেই সাদিও মানে, আগেরবার যে দায়িত্বটা পালন করতে পারেননি ঠিকঠাক। কোচের মতো দেশের জার্সি গায়ে পেনাল্টি মিসের যন্ত্রণায় পুড়েছেন যিনি নিজেও। ২০১৭ আফকনের কোয়ার্টারে পেনাল্টি শুটআউটে নিজের শট থেকে গোল করতে পারেননি মানে। টুর্নামেন্ট থেকে সেনেগালের বিদায়ঘণ্টা বেজে যায় তাতে।


প্রতিপক্ষ? সেই ক্যামেরুন!

সেনেগালের কোচ আলিউ সিসে
ছবি : এএফপি

১৫ বছর আগে যে দল কাঁদিয়েছিল মানের কোচকে। দেশ দুটির মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের মতো বৈরিতা না থাকলেও, দুই দল বেশ ভালোভাবেই একে অন্যের নাড়িনক্ষত্র চেনে। আফকনে মুখোমুখি হয়েছে বারবার। আর প্রতিবারই অধোবদনে মাঠ ছেড়েছেন কখনো সিসে, কখনো মানে। ২০০২ ও ২০১৭ আফকন ছাড়াও নিজেদের মাটিতে আয়োজিত ১৯৯২ সালের আফকনে ক্যামেরুনের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নিয়েছিল সেনেগাল।

এবার আর আক্ষেপ সঙ্গী হয়নি মানেদের
ছবি : এএফপি

গত রাতে তাই মিসরের জায়গায় প্রতিপক্ষ হিসেবে ক্যামেরুন থাকলে হয়তো আরেকটু তৃপ্তি পেতেন সিসেরা। প্রতিপক্ষ ক্যামেরুন না হলেও ক্যামেরুনের মাটিতেই জয়সূচক পেনাল্টি থেকে গোল করে দেশের আক্ষেপ ঘুচিয়েছেন মানে—ব্যাপারটা দায়মুক্তির আনন্দই দেবে সিসেকে।


বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এক বিশেষ ধর্মীয় আন্দোলনের উৎপত্তিস্থল হিসেবে আবির্ভূত হয় জ্যামাইকা। যে ধর্মের নাম ‘রাস্তাফারি’। পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রাসন, বর্ণবাদ ও পুঁজিবাদে যাঁতাকলে পিষ্ট আফ্রিকা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল এই ধর্মের কাছে। রাস্তাফারির অন্যতম প্রধান অনুসারী ছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী বব মার্লে।

মনে হতেই পারে, সেনেগালের কোচ আলিউ সিসের কথার মধ্যে হুট করে রাস্তাফারির প্রসঙ্গ আসছে কী করে?


আসছে এ কারণেই, সিসে নিজেও বব মার্লের মতো রাস্তাফারি ধর্মের একজন অনুসারী। আজীবন চুলও রেখেছেন মার্লের মতো করে। বব মার্লের জন্মদিন ছিল গতকাল। বব মার্লের বিখ্যাত গান ‘রিডেম্পশন সং’, যার সরাসরি বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—‘দায়মুক্তির গান’—সেটি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বব মার্লের জন্মদিনেই ২০০২ সাল থেকে বয়ে চলা এক দায় থেকে গত রাতে মুক্তি পেলেন সিসে!

ঠিক যেমন দায়মুক্তি ঘটেছিল কবির খানের, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ চলচ্চিত্রের শেষে!