স্কুলের ঘণ্টার শব্দও এত মধুর শোনায়!

বহুদিন পর বন্ধুদের কাছে পাওয়ার আনন্দ।
ছবি: প্রথম আলো

কাঠমান্ডুর সলটি মুডে হোটেলের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো মনটেসরি কিন্ডারওয়াল্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুল। রুম থেকে বের হয়ে সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে দূরের পাহাড় চোখ কেড়ে নেয়। আকৃষ্ট করে পাশের ছিমছাম সাজানো স্কুলটির মাঠটিও। দূর থেকেই বোঝা যায় পড়ার সঙ্গে বাচ্চাদের খেলার জন্য আছে নানা আয়োজন।

আজ সকালে ঘুম ভাঙল স্কুল থেকে ভেসে আসা জাতীয় সংগীতের সুরের মূর্ছনায়। সাউন্ড বক্সে বেজে চলছে সংগীত, তার সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে স্কুলের বাচ্চারা। করোনা যুগের আগের সময় হলে এমন কিছু নজরেও হয়তো পড়ত না! বাংলাদেশে এমন দৃশ্য তো আমরা সচরাচরই দেখে থাকি। কিন্তু সময়টা যে এখন অন্য রকম। করোনাভাইরাস নামের এক শত্রুকে কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না। যার জন্য বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে ঝুলছে বড় বড় তালা। আজই ঢাকায় আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ঈদের পর স্কুল খুলবে। তাই কাঠমান্ডুতে এসে অনেক দিন না শোনা স্কুলের ঘণ্টার শব্দও এত মধুর শোনাচ্ছে।

আবার স্কুলে ফেরার আনন্দ।
ছবি: প্রথম আলো

ছাত্রজীবনের বেশির ভাগ সময় স্কুলের প্রতি অনীহা ছিল। কোনো অজুহাতে বন্ধ হলেই হেসেছি তৃপ্তির হাসি। সেই স্কুল খোলা দেখা যে এত আনন্দের, তা বোধ হয় এর আগে আর কখনোই অনুভব হয়নি। রাস্তায় স্কুল ড্রেস পরা ছেলেমেয়েদের দেখতে পাওয়ায়ও খুশি হওয়া যায়, সেটা এই কাঠমান্ডুতে এসে টের পাচ্ছি।

হোটেল থেকে নেমে স্কুলে প্রবেশের লোভ সামলানো গেল না। অচেনা এক মানুষকে দেখে এগিয়ে এলেন স্কুলের এক শিক্ষিকা। পরিচয়ে সন্তুষ্ট হওয়ায় অল্প সময়ের জন্য অনুমতি মিলল ঘুরে দেখারও। শিশু শ্রেণি থেকে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ থাকা স্কুলটিতে লেখাপড়া আর কোথায়! সর্বত্রই খেলার আয়োজন।

করোনা যুগ শুরু হওয়ার পরই স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল নেপাল সরকার। ২০২১-এর মার্চে আবার মিলেছে স্কুল খোলার অনুমতি। তবে বাচ্চাদের স্কুলে আসতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। গড়ে ৮০ জন ছাত্রছাত্রীর অর্ধেক স্কুলে আসছে বলে জানালেন শিক্ষিকা অরুন্ধী। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে অভিভাবকদের কোনো ভীতিও নেই বলে জানালেন তিনি।

ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি বসে ক্লাস করছেন দিব্যি। সর্বত্রই করোনা ‘জয়’ করে নতুন জীবনের স্পন্দন।

এই স্কুলের গলির মুখেই এভারেস্ট ইনোভেটিভ কলেজ। কলেজ ছুটির পর কৈশোর পেরোনো ছেলেমেয়েরা মুখে মাস্ক লাগিয়ে হই হুল্লোড় করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। করোনাভীতি কাটিয়ে আবার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটার আনন্দ তাঁদের চোখেমুখে । অনলাইন ক্লাসে কি আর সে আনন্দ মেলে!

একাদশ শ্রেণিতে পড়েন শামিকশা তিমালশিনা। নতুন স্বাভাবিকে কলেজে আসার আনন্দটা তাঁর মুখ থেকেই শুনুন, ‘বাসায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। অনলাইন ক্লাস করে আর ভালো লাগছিল না। কলেজ খোলার পর মনে হচ্ছে মুক্তি পেয়েছি। করোনা নিয়ে এখন আর কোনো ভয় নেই। মাস্ক ব্যবহার করছি। সবকিছুই তো আগের মতোই চলছে।’

কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ঘুরে দেখা গেল কলেজের ক্লাসরুমগুলোও। ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি বসে ক্লাস করছেন দিব্যি। সর্বত্রই করোনা ‘জয়’ করে নতুন জীবনের স্পন্দন। তিন জাতি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট কভার করতে এসে ছেলেমেয়েদের যে প্রাণখোলা হাসিমুখ দেখার সৌভাগ্য হলো অনেক দিন পর।

ক্লাসে বসার আনন্দ আবারও ফিরে এসেছে।
ছবি: প্রথম আলো

টানা ৯ মাস অনলাইনে ক্লাস করানোর পর ছাত্রদের কাছে পেয়ে খুশি শিক্ষকেরাও। কলেজটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হরি কাফলে বলছিলেন, ‘ছেলেমেয়েরা কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়াই কলেজে আসছে। অনলাইনে ক্লাস করতে করতে তারা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমদেরও খারাপ লাগছিল। এখন তাদের কাছে পাওয়াতে ভালো লাগছে। কারও জ্বর ,সর্দি বা কাশি থাকলে কলেজে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। বাকি সবকিছু আগের মতোই চলছে।’

নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে করোনা পরিস্থিতিতে একটা পার্থক্যই আবিষ্কার করা গেল—বাংলাদেশের স্কুল এখনো খোলেনি আর নেপালের স্কুল খুলেছে। বাকি সবকিছুতেই ঢাকার ছাপ। প্রায় সব মানুষের মুখে মাস্ক আছে। কিন্তু অনেকের সেটা নেমে এসেছে থুতনিতে। দুই দেশেই করোনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।