স্লোভাকিয়া: ভরসা অভিজ্ঞদের ওপর

প্রত্যাশার চাপ নেই স্লোভাকিয়ার ওপর।ছবি: রয়টার্স
প্রশ্নটা আসলেই প্রায় এক শ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় এক শ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে আগামী ১১ জুন, শেষ ১১ জুলাই। ইউরোতে অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।

বায়ার্ন মিউনিখের নতুন কোচ ইউলিয়ান নাগলসমান আর স্তেফান তারকোভিচের মধ্যে মিল আছে বেশ। আপনার অনুসন্ধানী মন যদি প্রশ্ন করে ওঠে, ‘তারকোভিচ কে’, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। সব সময় পর্দার আড়ালে থাকা লোকটাকে আপনার চেনার কথাও নয়। ২০১৬ ইউরোতে দলের সহকারী কোচের ভূমিকায় থাকা এই ভদ্রলোকের হাতেই এবার স্লোভাকিয়ার দায়িত্ব। নাগলসমানের মতো চোটের কারণে আগেভাগে নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানা যে কোচ এখন হাত পাকাচ্ছেন দল সামলানোয়।

আগের কোচ পাভেল হাপালের অধীনে ম্যাড়মেড়ে ফুটবল খেলা স্লোভাকিয়ার ফর্মও ছিল জঘন্য। কোচ বদলানোর পর শেষ মুহূর্তে আয়ারল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জ্বলে উঠে ইউরোতে এসেছে। ইউরো উপলক্ষে এর মধ্যেই ২৪ সদস্যের দল ঘোষণা করে দিয়েছেন তারকোভিচ। জেনে নেওয়া যাক দলটা সম্পর্কে।

কোচ স্তেফান তারকোভিচ।
ছবি: টুইটার

স্লোভাকিয়া

ফিফা র‍্যাঙ্কিং: ৩৬

যাঁরা আছেন দলে

গোলকিপার: মার্টিন দুবরাভকা (নিউক্যাসল ইউনাইটেড), মারেক রোদাক (ফুলহাম), দুসান কুসিয়াক (লেচিয়া দানস্ক)

সেন্টারব্যাক: মিলান স্ক্রিনিয়ার (ইন্টার মিলান), লুবোমির সাতকা (লেচ পোজনান), দেনিস ভাভরো (উয়েস্কা)

রাইটব্যাক/ রাইট উইংব্যাক: পিটার পেকারিক (হার্থা বার্লিন)

লেফটব্যাক/ লেফট উইংব্যাক: টমাশ উবোকান (ওমোনিয়া), ইয়াকুব হোলুবেক (গ্লিউইস)

সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার: স্তানিস্লাভ লোবোতকা (নাপোলি), ইউরাই কুতস্কা (পারমা), প্যাট্রিক রোসোভস্কি (গেন্ট), মাতুশ বেরো (ভিতেসে আর্নহেম)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার: মারেক হামশিক (গোটেবোর্গ), অন্দ্রেই দুদা (এফসি কোলন), টমাশ সুসলোভ (গ্রোনিঙ্গেন), লাজলো বেনেস (অগসবুর্গ)

উইঙ্গার/ওয়াইড মিডফিল্ডার: ভ্লাদিমির ভেইজ (স্লোভান ব্রাটিস্লাভা), রবার্ট মাক (ফেরেনৎভারোস), লুকাশ হারাসলিন (সাসসুয়োলো), এরিক ইরকা (রেড স্টার বেলগ্রেড)

স্ট্রাইকার: মিশাল দুরিশ (ওমোনিয়া), রবার্ট বোজেনিক (ফেইনুর্দ), ডেভিড স্ত্রেলেক (স্লোভান ব্রাটিস্লাভা)

কোচ
স্তেফান তারকোভিচ

অধিনায়ক
মারেক হামশিক

ইউরোতে সেরা সাফল্য
দ্বিতীয় রাউন্ড (২০১৬)

গ্রুপে প্রতিপক্ষ
পোল্যান্ড (১৪ জুন)
সুইডেন (১৮ জুন)
স্পেন (২৩ জুন)

দলের রক্ষণভাগের নেতৃত্ব মিলান স্ক্রিনিয়ারের কাছে।
ছবি: টুইটার

শক্তি

স্লোভাকিয়ার এই দলটার সবচেয়ে শক্তির জায়গা দুটি—রক্ষণভাগ ও মাঝমাঠ। লিভারপুলের সাবেক ডিফেন্ডার মার্টিন স্কারটেল যাওয়ার পর দলের রক্ষণভাগের নেতৃত্ব নিয়েছেন মিলান স্ক্রিনিয়ার, সদ্যই ইন্টার মিলানের হয়ে ইতালিয়ান লিগ জেতা এই ডিফেন্ডারের নাম বর্তমান সময়ে বিশ্বের সেরা সেন্টারব্যাকদের তালিকায় থাকবেই। রক্ষণের পেছনে গোলকিপার হিসেবে থাকবেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল নিউক্যাসলের মার্টিন দুবরাভকা ও ফুলহামের মারেক রোদাক। এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমিত হয়ে যাওয়া ফুলহামের গোলপোস্টে রোদাক সেভাবে নিয়মিত খেলতে না পারলেও দুবরাভকা কয়েক মৌসুম ধরেই নিউক্যাসলের প্রথম পছন্দের গোলকিপার।

অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে কিংবদন্তি মারেক হামশিক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। দিয়েগো ম্যারাডোনা-পরবর্তী যুগে নাপোলির সবচেয়ে বড় তারকা চীন ঘুরে এখন খেলছেন সুইডেনের গোটেবোর্গে। এবারের ইউরোই হয়তো স্লোভাকিয়ার জার্সিতে ৩৩ বছর বয়সী আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের শেষ টুর্নামেন্ট।

হামশিক খেলবেন?
ছবি: রয়টার্স

তবে টুর্নামেন্টে একাদশে হামশিকের জায়গা একেবারে পাথরে খোদাই করা মোটেও নয়। হামশিক ছাড়াও এই জায়গায় খেলানোর জন্য স্লোভাকিয়ার আছে টমাশ সুসলোভ, যাঁকে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার ডেভিড সিলভার স্লোভাকিয়ান সংস্করণ বলা হচ্ছে। বুন্দেসলিগায় খেলা এফসি কোলনের অন্দ্রেই দুদাও এই পজিশনে খেলার দাবিদার।

সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে আছেন এসি মিলানের সাবেক ও বর্তমানে পার্মায় খেলা মিডফিল্ডার ইউরাই কুচকা আর নাপোলির মিডফিল্ডার স্তানিস্লাভ লোবোৎকা। স্লোভাকিয়ার গোলের বেশির ভাগই যে মিডফিল্ড থেকেই আসে, তার কারণ এই নামগুলোই।
হামশিক, দুবরাভকা, দুদা, লেফটব্যাক উবোকান, রাইটব্যাক পেকারিক, কুচকা, উইঙ্গার ভ্লাদিমির ভাইস ও রবার্ট মাক, স্ট্রাইকার মিশাল দুরিশ—সবাই-ই ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে খেলছেন অনেক দিন হলো। তাঁদের অভিজ্ঞতাই ভালো কিছুর আশা দেখায় দলটাকে।

দুর্বলতা

দলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা নিঃসন্দেহে গোলশিকারি একজন স্ট্রাইকারের অনুপস্থিতি। উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মিশাল দুরিশের অতিরিক্ত সময়ের গোলে স্লোভাকিয়ার ইউরো খেলা নিশ্চিত হলেও এই স্ট্রাইকার গোল করার ক্ষমতায় সংশয়ের কারণ জানান দেবে পরিসংখ্যান। জাতীয় দলে ৫৪ ম্যাচে দুরিশের গোল মাত্র ৭টি। এবার সাইপ্রাসের লিগে ২২ ম্যাচে গোল করেছেন মাত্র ২টি। ওদিকে তরুণ ডেভিড স্ত্রেলেকের প্রতিভার ওপর কোচ তারকোভিচের ভরসা থাকলেও ইউরোর মতো মঞ্চে তিনি কতটুকু আলো ছড়াতে পারবেন, সে নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

স্লোভাকিয়ার সম্ভাব্য একাদশ
ছবি : সংগৃহীত

সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-১-৪-১)

দায়িত্ব নেওয়ার পর দল সাজানোর জন্য তারকোভিচ পেয়েছেন মাত্র ছয় ম্যাচ। এর মধ্যে দুটি বাদে প্রত্যেক ম্যাচেই দলকে খেলিয়েছেন ৪-১-৪-১ ছকে। ইউরোতেও এই ছকেই স্লোভাকিয়াকে দেখা যেতে পারে। গোলকিপার হিসেবে দুবরাভকার সামনে স্ক্রিনিয়ারের সঙ্গে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে জুটি বাঁধবেন ভাভরো। রক্ষণের ডানে পেকারিক ও বাঁয়ে উবোকানের জায়গা পাকা। রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে নাপোলির লোবোৎকারও তা-ই। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ও উইঙ্গার হিসেবে যে চারজন খেলবেন, এদের মধ্যে হামশিকের সঙ্গে মাক, দুদা ও কুচকার খেলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। স্ট্রাইকার পজিশনের জন্য জোর লড়াই চলবে দুরিশ আর স্ত্রেলেকের।

রক্ষণভাগে দুই সেন্টারব্যাক স্ক্রিনিয়ার ও ভাভরোর ভূমিকা দুই ধরনের। সামনে গিয়ে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া, বাতাসে ভেসে আসা বল হেড করে সরিয়ে দেওয়া—এগুলো ভাভরোর প্রাথমিক দায়িত্ব। স্ক্রিনিয়ারের ভূমিকা পেছন থেকে নিখুঁত পাস দিয়ে খেলা গড়ে দেওয়া, আর দরকার পড়লে ভাভরোর পেছনে থেকে ট্যাকল করা। তাঁদের ওপরে থাকা লোবোৎকার কাজ রক্ষণকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি আক্রমণভাগের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন।

কঠিন গ্রুপে পড়েছে স্লোভাকিয়া।
ছবি: টুইটার

আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ও উইঙ্গার হিসেবে যারা খেলবেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ভেতরে ঢুকে খেলতে পছন্দ করেন। সে ক্ষেত্রে দুই ফুলব্যাকের ভূমিকা থাকবে সাইডলাইন ঘেঁষে ওঠানামা করে মিডফিল্ডারদের মাঠের মাঝের জায়গাগুলোতে খেলতে সাহায্য করা। মূল স্ট্রাইকার দুরিশকে দেখা যাবে নিচে নেমে খেলা গড়ে দিতে, যাতে দুদা, হামশিক কিংবা মাকের মতো আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডাররা বক্সে ঢুকে শট নেওয়ার সুযোগ পান। ম্যাচের শেষ দিকে স্ত্রেলেক নেমে প্রতিপক্ষের হাঁপিয়ে যাওয়া রক্ষণকে যন্ত্রণা দিতে পারেন তাঁর গতি আর শট নেওয়ার প্রবণতা দিয়ে।

আমি জানি, খেলোয়াড় হিসেবে আমার প্রতিভা আর শারীরিক সক্ষমতা সীমিত, তাই কোচিংয়ে মনোযোগ দিয়েছি
স্তেফান তারকোভিচ

প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

খুব বড় অঘটন ঘটলে ভিন্ন কথা, না হলে পোল্যান্ড বা স্পেনকে টপকে স্লোভাকিয়াকে নকআউট পর্বে কল্পনা করা কঠিন। গ্রুপের আরেক প্রতিপক্ষ সুইডেনের বিপক্ষে ২০১৭ সালে আধ ডজন গোল খেয়েছিলেন হামশিকরা। একটা অঘটন কিংবা অন্তত সুইডেন ম্যাচ থেকে কিছু আদায় করে নেওয়া—এতটুকুতেই হয়তো বলা যাবে, স্লোভাকদের ইউরো একেবারে মন্দ কাটেনি।