‘হিমাগারে’ স্মৃতিময় মারদেকা কাপ
মারদেকা...নামটা শুনলেই বাংলাদেশের সত্তরের দশকের ফুটবলাররা নড়েচড়ে বসেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল মালয়েশিয়ার এই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে। যে কারণে নামটার সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের একঝাঁক ফুটবলারের, যাঁদের পায়ে-পায়ে স্বাধীনতার পর দেশের ফুটবল নতুন যাত্রা শুরু করেছিল।
স্মৃতিময় মারদেকা কাপের শহর কুয়ালালামপুরে এখন চলছে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব। যেখানে খেলেছে বাংলাদেশও। কিন্তু ২০২২ ছাপিয়ে ফিরে ফিরে আসছে ১৯৭৩ সালের জুলাই-আগস্ট সময়টা, যখন জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে মারদেকা কাপে প্রথম খেলতে এসেছিল বাংলাদেশ। তখন একটা শিহরণ ছিল প্রতাপ শংকর হাজরা, কাজী সালাউদ্দিন, ছোট নাজিরদের মনে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচটা ছিল থাইল্যান্ডের বিপক্ষে। ২-২ গোলে ড্র হওয়ার পর যেটিতে টাইব্রেকারে হারে বাংলাদেশ। সফরটা ছিল শিক্ষাসফরের মতোই।
পরেরবার ১৯৭৫ মারদেকায় খেলতে এসে ফেরার ঠিক আগে বাংলাদেশ দল পেয়েছিল সপরিবার বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর। যার প্রতিবাদে ফুটবলাররা ১৫ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ম্যাচ খেলতে আপত্তি পর্যন্ত তুলেছিলেন।
সব মিলিয়ে ১৯৭৩ সালের ১৭তম মারদেকা ও ১৯৭৫ সালের ১৯তম মারদেকা—দুটি টুর্নামেন্টে খেলা ফুটবলারদের অন্যতম ডিফেন্ডার শেখ আশরাফ আলীর কাছে সেই স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে, ‘মালয়েশিয়ানরা তখন আমাদের দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। মাঠ থেকে বের হওয়ার পর জিজ্ঞেস করত, “হোয়ার আর ইউ ফ্রম?” বলতাম, বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ চেনে না ওরা। বলত, “ইন্ডিয়া, পাকিস্তান?” “না” বললে বলত, “শেখ মুজিব?” আমরা “হ্যাঁ” বলতাম। আসলে তখন তারা বাংলাদেশকে চিনত না। কিন্তু শেখ মুজিবকে চিনত।’
টুর্নামেন্টটির পোশাকি নাম পেস্তবেলা মারদেকা কাপ। মারদেকা মানে স্বাধীনতা। ৩১ আগস্ট মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা দিবস। পেস্তবেলা অর্থ ফুটবল উৎসব। স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের অংশ হিসেবেই টুর্নামেন্টটির প্রবর্তন ১৯৫৭ সালে। ১৯৮৮ পর্যন্ত এটি প্রতিবছর আয়োজিত হয়েছে। এর পর থেকেই অনিয়মিত। ৬৫ বছরে হয়েছে ৪১ বার। বাংলাদেশসহ খেলেছে ৩৫টি দল।
অনেক দিন পর ২০০৮ সালে আমন্ত্রণ পেয়ে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। মোজাম্বিক ও মিয়ানমার—দুই দলের কাছেই হেরেছিল ১-০ গোলে। ভিয়েতনাম অনূর্ধ্ব-২৩ (পরে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন) দলের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করতে পেরেছিল এমিলি আর জাহিদ হোসেনের গোলে। এরপর আর মাত্র ২০১৩ সালে একবার টুর্নামেন্টটি হয়েছে। সেবার চ্যাম্পিয়ন মালয়েশিয়ার অনূর্ধ্ব-২৩ দল।
৯ বছর ধরে হিমাগারে থাকা টুর্নামেন্টটি আবার হবে কি না, মালয়েশিয়ার ফুটবল মহলের কাছে এর কোনো উত্তর নেই। কুয়ালালামপুরের স্থানীয় সাংবাদিক ওই কান ফান বললেন, ‘আমার ধারণা, স্পনসর একটা সমস্যা হতে পারে। তা ছাড়া ঘরোয়া আর জাতীয় দলের অনেক খেলা এখন। ফলে মারদেকা কাপ বন্ধ আছে। ফেডারেশন হয়তো আবার করবে, কিন্তু কবে করবে, জানি না। খুব শিগগির কোনো সম্ভাবনা দেখি না।’
এখানকার সংগঠকেরাও এ বিষয়ে অন্ধকারে। মালয়েশিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আবু বাকরও দিতে পারলেন না টুর্নামেন্টটি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার কোনো ধারণা, ‘আসলে মারদেকার জন্য সময় বের করা এখন অনেক কঠিন।
জাতীয় দলের অনেক খেলা থাকে। এশিয়ান কাপ, বিশ্বকাপ কাপ বাছাই, আসিয়ান কাপ খেলি আমরা। লিগ চলে অনেক লম্বা সময়। ফলে মারদেকা কাপ আয়োজন করা যাচ্ছে না।’
তাহলে বিলুপ্তই হয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী মারদেকা টুর্নামেন্ট? এই কর্মকর্তা ‘হ্যাঁ বা ‘না’—কোনোটিই বলেননি, ‘বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলব না। আবার কবে হবে, সেটা বলাও কঠিন।’
স্থানীয় ফুটবল মহলের চাওয়া, ৯ বছর ধরে ‘মৃত’ মারদেকা কাপ আবার পুনরুজ্জীবিত হোক। সেটি হলে বাংলাদেশের ফুটবলেও তা একটা অনুরণন তুলবে।