হৃদয়ে থেকে যাবেন ম্যারাডোনা

বুয়েনস এইরেস থেকে বার্সেলোনা, নাপোলি থেকে ঢাকা—সবখানেই মানুষের মন জিতে নিয়েছেন ম্যারাডোনা।

কাঁদছে আর্জেন্টিনা, কাঁদছে পুরো ফুটবল বিশ্ব। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ফুটবল কিংবদন্তিকে চিরবিদায় জানাতে গিয়ে কাঁদছেন ভক্তরা। গতকাল বুয়েনস এইরেসেছবি: রয়টার্স

আর্জেন্টিনার সময় তখন বুধবার দুপুর ১২টা। বুয়েনস এইরেসের সান আন্দ্রেস অঞ্চলের এক ব্যক্তিগত ক্লিনিক। ডিয়েগো ম্যারাডোনার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। নার্স ডাকলেন। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সাড়া নেই। প্রমাদ গুনলেন নার্স।

বুয়েনস এইরেসেই থাকা তাঁর তিন মেয়ে জিয়ান্নিনা, দালমা আর ইয়ানাকে খবর দেওয়া হলো। ডাকা হলো অ্যাম্বুলেন্স। আর্জেন্টাইন দৈনিক ক্লারিন প্রথম জানাল, ম্যারাডোনা জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অ্যাম্বুলেন্স ছোটে হাসপাতালে, কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ঘুমের দেশ থেকেই ততক্ষণে চিরঘুমের পথে গন্তব্যহীন যাত্রা আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির। ষাট বছরের মধ্যে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় নিরন্তর আলোচনায় থাকা, মানুষের ভালোবাসায় ভাসা জীবনের শেষটা হলো কত নীরবে!

তাঁর জীবন গৌরবের চূড়া দেখেছে, বিতর্কের অতলেও তলিয়ে যেতে যেতে ফিরে এসেছে বারবার। যে জীবন তাঁর প্রতি সাধারণের ভালোবাসায় সীমা মানতে দেখেনি, মাত্রা মানতে দেখেনি কোকেন-অ্যালকোহলের প্রতি তাঁর আসক্তিতেও। যে জীবনে ফুটবল তাঁর প্রতিভাকে ভাসিয়েছে পুরস্কারে পুরস্কারে, ফুটবলের বাইরের জগৎটা তাঁকে টেনেছে অতল অন্ধকারে। স্বাস্থ্য তো এই শতকের শুরু থেকেই ম্যারাডোনার জীবনকে সংশয়ে ফেলেছে কয়েকবার, সেটি সত্ত্বেও শরীরে মাদককে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ ম্যারাডোনা নিজেই করে দিয়েছেন বারবার।

এত কিছুর মধ্যেও একটা ব্যাপার সব সময় ম্যারাডোনার জীবনে ধ্রুবক হয়ে থেকেছে, হয়তো ম্যারাডোনার চালিকা শক্তিও—মানুষের সীমাহীন ভালোবাসা।

মৃত্যু ম্যারাডোনাকে অন্যলোকে নিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুরই-বা কী সাধ্য মানুষের ভালোবাসার আবেশ থেকে ম্যারাডোনাকে নিয়ে যায়! সেখানে যে ম্যারাডোনার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত‍!’ হবে নাই–বা কেন? ফুটবল ইতিহাস রাঙানো তারকা তো অনেকই এসেছেন, আরও অনেকে আসবেন, কিন্তু ম্যারাডোনার মতো করে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পেরেছেন কজন?

ম্যারাডোনা কতটা মানুষের তারকা, সেটির একটা প্রমাণ ফিফার গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারই দিয়ে যায়। যাঁর সঙ্গে আমৃত্যু ‘কে সেরা’ বিতর্কটায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলেছে ম্যারাডোনার, সেই পেলের সঙ্গে ফিফার পুরস্কারটায় ভাগাভাগি ছিল ম্যারাডোনার। কিন্তু ব্রাজিল কিংবদন্তির পুরস্কার যেখানে এসেছিল ফিফার বিচারকদের রায়ে, ম্যারাডোনা জিতেছিলেন মানুষের ভোটে।

‘পেলে না ম্যারাডোনা’ বিতর্কটা তো ফুটবলের সর্বজনীন, চায়ের কাপে ঝড় তুলতে পারত আর্জেন্টিনার নিজস্ব একটা বিতর্কও—মেসি না ম্যারাডোনা? কিন্তু বিতর্কটা জমেনি কখনো। কেন, সে ব্যাখ্যায় ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে একা হাতে ছিয়াশি বিশ্বকাপ জেতানো আর মেসির কখনো বিশ্বকাপ না জেতার ভূমিকা অনেক বড় ঠিকই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভূমিকা হয়তো এটির যে ম্যারাডোনা তারকা হয়েও মানুষের আপন, মেসি পাশের বাড়ির ছেলেটি হয়েও আর্জেন্টাইনদের চোখে দূরের কেউ।

মেসি পরিপাটি, বিতর্কহীন চরিত্রের একজন। সেখানে বিতর্ককে আস্তিনে বেঁধে চলা ম্যারাডোনার প্রতি আর্জেন্টাইনদের এত ভালোবাসা কেন? ম্যারাডোনার মধ্যে যে আর্জেন্টাইনরা নিজেদের খুঁজে পায়! ম্যারাডোনার বিতর্কগুলোর কারণে তিনি আর্জেন্টাইনদের কাছে ভুল-শুদ্ধে গড়া আর দশজনের মতো। ২০০১ সালে নিজের শেষ ম্যাচে বোকা জুনিয়র্সের মাঠে তাই যখন ম্যারাডোনা ভরা গ্যালারির সামনে বুকে দুই হাত আড়াআড়ি রেখে নিজের ভুলগুলো স্বীকার করে নেন, তাঁকে বুকে টেনে নেয় আর্জেন্টাইনরা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনা যখন হাতের টোকায় বল ঢুকিয়ে দেন ইংল্যান্ডের জালে, আর্জেন্টাইনদের মনে হয়, তাঁদের মতো পোড় খেতে খেতে যেকোনো মূল্যে জয়ের মন্ত্রটা এই ছেলেটাও নিজের মনে গেঁথে নিয়েছে। টাচলাইনের এক পাশে ‘মানুষ’ ম্যারাডোনা টাচলাইনের ওপাশে সবুজ মাঠের ‘সুপারম্যান’ হয়ে উঠেছেন বলেই হয়তো ম্যারাডোনাকে রীতিমতো পূজা করেছে আর্জেন্টাইনরা।

শুধু আর্জেন্টিনাই কেন, পেশাদারত্বের খোলস ছেড়ে আবেগের এমন সরল প্রকাশের ক্ষমতা ছিল বলেই হয়তো ম্যারাডোনা বিশ্বজুড়েই মানুষের কাছের একজন। ম্যারাডোনা মাদক নিয়েও সে জন্য আবার কাঁদতে কাঁদতে ভুল স্বীকার করতে জানেন। মেসি কিংবা পেলে, বা আর দশজন তারকা রাজনৈতিক আলোচনা থেকে তফাতে থাকলেই বাঁচেন, ম্যারাডোনা সেখানে চে গুয়েভারার বিপ্লবী আদর্শ বুকে ধারণ করার কথা জানাতে নিষ্কম্প। দক্ষিণ আমেরিকান বিপ্লবী নেতার উল্কি বাহুতে আঁকা ছিল তাঁর, কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব সর্বজনবিদিত।

ম্যারাডোনাকে কীভাবে দেখেছে আর্জেন্টাইনরা, সেটি সম্ভবত সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় পেপ গার্দিওলার কথায়। ম্যারাডোনার স্মরণে কাল ম্যানচেস্টার সিটির কোচ বলছিলেন আর্জেন্টিনায় দেখা তাঁর এক ব্যানারের কথা, যেখানে লেখা ছিল, ‘তুমি তোমার জীবন নিয়ে কী করেছ, তা নিয়ে আমরা ভাবি না ডিয়েগো, আমাদের জীবন তুমি কীভাবে রাঙিয়েছ, তা-ই মনে রাখি।’

আর এত বিতর্ক আর মাদকের নেশার কারণে তাঁর প্রতি কারও বিরক্তি থাকলে সেটি ভুলিয়ে দেওয়ার মতো ফুটবল তো ছিলই! যে ফুটবলে সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ ছিল, ছিল তাঁর চরিত্রের সঙ্গে মিল রাখা খেয়ালিপনাও। ১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর, তাঁর ১৬তম জন্মদিনের ১০ দিন আগে যখন আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের জার্সিতে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হচ্ছে ম্যারাডোনার, দলের কোচ হুয়ান কার্লোস মন্তেস মাঠে নামার সময় ম্যারাডোনাকে শুধু বলেছিলেন, ‘তুমি যা জানো, তা-ই করো। পারলে দু-একটা নাটমেগও (প্রতিপক্ষের পায়ের ফাঁক গলে বল নিয়ে যাওয়া) করো।’ মাঠে নামার কয়েক মুহূর্ত পর প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের পায়ের ফাঁক গলে বল নিয়ে যাওয়া ম্যারাডোনার এই আনন্দটাই ছিল তাঁর ফুটবলের বিজ্ঞাপন!

২০১৭ সালে ফুটবলবিষয়ক সাময়িকী ফোরফোরটু সর্বকালের সেরা ১০০ ফুটবলারের তালিকায় ম্যারাডোনাকে সবার ওপরে রাখার ব্যাখ্যায়ও এই আনন্দকেই রেখেছে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে। পেলে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন, তিনটি বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন ব্রাজিলকে, মেসি তাঁর ক্লাব বার্সেলোনায় কত শিরোপা জিতেছেন...তবু ম্যারাডোনাকে শীর্ষে রাখার ব্যাখ্যায় সাময়িকীর সম্পাদক অ্যান্ড্রু মারে যা লিখেছিলেন, সেটির সারাংশ এই—আপনি সবচেয়ে পছন্দের গান নির্বাচনে যে অ্যালবাম সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে কিংবা বিশ্লেষকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে সেটিকে রাখেন, নাকি সেই অ্যালবামকে রাখেন, যেটি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে?

ম্যারাডোনাও তেমনই, মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই তাঁর। মৃত্যুরও সেখানে হাত দেওয়ার অধিকার নেই।