‘হোসে’ নন জোসে মরিনহো

অ্যামাজন প্রাইমে বের হয়েছে সিরিজের প্রথম তিন পর্ব।ছবি : সংগৃহীত

সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে ‘স্পেশাল ওয়ান’ বলা থেকে শুরু করে উদ্ভট সব অভিযোগে নিজের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষ, রেফারি সবাইকে অভিযুক্ত করা, টাচলাইনে প্রতিপক্ষ ম্যানেজারের সঙ্গে হাতাহাতি করা, চোখে গুঁতো দেওয়া, ড্রেসিংরুমের খেলোয়াড়দের চক্ষুশূল হওয়া, মাঠে বিতর্কিতভাবে গোল উদ্‌যাপন করা, নিজ দলের চিকিৎসকের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঝগড়া— গত দেড় দশকে জোসে মরিনহো'র কল্যাণে আমরা পাগলামির প্রতিটা উদাহরণ দেখেছি বিস্তারিতভাবে।

মরিনহো এমনই। দুর্বিনীত, অকপট, ঠোঁটকাটা। নিন্দুকেরা তো লজ্জাহীন, বেয়াদব বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। এমন এক ম্যানেজারের ক্লাব নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হবে, আর তাতে মরিনহো সব আলো কেড়ে নেবেন না, তা কী হয়?

গতকাল ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট অ্যামাজন প্রাইম টটেনহাম নিয়ে নির্মিত বহুল প্রতীক্ষিত তথ্যচিত্র 'টটেনহাম হটস্পার— অল অর নাথিং’ এর প্রথম তিন পর্ব মুক্তি দিয়েছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই টটেনহামের কোচ মরিনহো সিরিজের ‘এমভিপি’ (মোস্ট ভ্যালুয়েবল পারসন) হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। অবশ্য মরিনহো যেখানে থাকবেন, সে এলাকার যে মরিনহো ছাড়া একাধিক ‘বাঘ’ থাকবে, সেটা কল্পনাই বা করা যায় কীভাবে?

‘আমার নাম জোসে। হোসে না। আমি যদি আর্জেন্টাইন হতাম তাহলে আমার নাম হোসে হতো!’
জোসে মরিনহো, টটেনহাম ম্যানেজার

এখানেও একটা ‘কিন্তু’ আছে। হোসে মরিনহো? না জোসে মরিনহো? এত কাল ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পর্তুগিজ এই ম্যানেজারকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ক্রমাগত ‘হোসে’ ডেকে যাওয়া মানুষজন এই সিরিজের মাধ্যমে আবারও নতুন করে জেনেছেন, তাঁর নাম ‘জোসে’, ‘হোসে’ নয়। প্রথম দিন খেলোয়াড়দের অনুশীলন করাতে গিয়ে বন্ধুবৎসল মরিনহো জেনেছেন প্রত্যেক শিষ্যের নাম, নামের উচ্চারণ। ফাঁকে নিজের উচ্চারণটাও বলে দিয়েছেন, ‘আমার নাম জোসে। হোসে না। আমি যদি আর্জেন্টাইন হতাম তাহলে আমার নাম হোসে হতো!’

বিশ্বের সব ক্রীড়া সাংবাদিকদের কানে কথাটা গেলে হয় এখন!

বলছিলাম মরিনহোর বন্ধু বাৎসল্যের কথা। কথাটা আশ্চর্য ঠেকতে পারে। মরিনহো কোনো কালে খেলোয়াড়দের বন্ধু হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন? যে দলেই গেছেন, খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে তবে বিদায় নিয়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদে কাকা-রামোস থেকে শুরু করে আরবেলোয়া-ক্যাসিয়াস, চেলসিতে চেক-শেভচেঙ্কো, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পগবা-সানচেজ ; মরিনহো চলে যাওয়ার পর সবাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। তবে এর আগে প্রিমিয়ার লিগে তিন-তিনবার ছাঁটাই হওয়া এই কোচ টটেনহামের চাকরিটাকে যে একটু হলেও আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেটা বোঝা গেছে। হয়তো ভেবেছেন, আরেকবার ছাঁটাই হলে হয়তো বিশ্বের সেরা ম্যানেজারের কাতারে আর থাকা হবে না তাঁর, এমনিতেই অনেকে এখন মরিনহোকে সেরা ম্যানেজারদের কাতারে রাখতে চান না।

যারা রাখতে চান না, তাদের দলে অবশ্য টটেনহামের সভাপতি ড্যানিয়েল লেভি নেই। তথ্যচিত্রে অকপটভাবে স্বীকার করেছেন, বর্তমান বিশ্বের সেরা দুই ম্যানেজারের একজন এখন তাঁর দলে আছেন। বাকিজন প্রিমিয়ার লিগের অন্য আরেকটা ক্লাবের দায়িত্বে। তবে তিনি কে, নাম বলেননি লেভি। পেপ গার্দিওলা হতে পারেন, হতে পারেন ইয়ুর্গেন ক্লপও।

সিরিজের একটি দৃশ্য।
ছবি : সংগৃহীত

প্রথম থেকেই খেলোয়াড়দের বন্ধু হতে চেয়েছেন মরিনহো। দলের মূল খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাদা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়তে চেয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন দলের সহ-অধিনায়ক হ্যারি কেইন, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এরিক ডায়ার ও মিডফিল্ডার ডেলে আলি। দেড় দশক ধরে শীর্ষ পর্যায়ের কোচিং করিয়ে মরিনহো একটা জিনিস অবশেষে শিখেছেন হয়তো, ক্লাবে প্রভাব বিস্তার করতে হলে প্রভাব বিস্তারকারী খেলোয়াড়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা আবশ্যক।

আরেকটা জিনিস চেয়েছেন, ম্যাচের নব্বই মিনিটে তাঁর খেলোয়াড়েরা যেন বিশ্বের সবচেয়ে বাজে মানুষে পরিণত হয়। বিশেষ কিছু শব্দ উচ্চারণ করেছেন, সংগত কারণেই উল্লেখ করা হলো না। মরিনহোর বার্তা পরিষ্কার, নব্বই মিনিটে পৃথিবীর জঘন্যতম স্বার্থপর মানুষে পরিণত হতে হবে। না হলে যে জেতা যাবে না কিছু!
'আমি তোমাদের বিপক্ষে অনেক ম্যাচ খেলেছি, আমি আশ্চর্য হয়েছি, তোমরা কেউ আমাকে একবার গালিও দাওনি, অসম্মান কর নি!', মরিনহোর ইঙ্গিত স্পষ্ট, মাঠে একটু ঘাড় ত্যাড়া না হলে শিরোপার আশা অধরাই থেকে যাবে। ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল বানিয়েও যে শিরোপা অধরা থেকে গিয়েছিল মরিনহোর উত্তরসূরি মরিসিও পচেত্তিনোর কাছে।

সমালোচনা জিনিসটা মরিনহো পছন্দ করেন না, সেটা প্রকাশ্যে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য বা কার্যকলাপ দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু চার দেওয়ালের ভেতরেও যে সমালোচনা জিনিসটা তাঁর গায়ে বিঁধে, সেটাও দেখা গেছে তথ্যচিত্রে। প্রথম দিন অফিসে এসে চোখে চশমা পরে কাজ করতে শুরু করা মরিনহোর কানে আসে স্কাই স্পোর্টসের দুই ক্রীড়াবিশ্লেষকের বক্তব্য, যারা মরিনহোর খেলানোর ধরন নিয়ে সমালোচনা করছিলেন।
মুখ খারাপ করে টিভি বন্ধ করে দেওয়া ওই মরিনহোই তো আমাদের সবার চেনা, সবার জানা!