১০০ গোল করা নেইমারের উত্তরসূরির দাম ১০ কোটি

নেইমারদের পথ ধরে সান্তোসে উঠে আসছেন নতুন এক তারকা।ছবি: রয়টার্স

করোনাকে পাশ কাটিয়ে ব্রাজিলে ফুটবল ফেরার পর থেকে ঘটনাবহুল কয়েকটা মাস কেটেছে মার্কোস লিওনার্দোর।

ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব সান্তোসে খেলা ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড ১৭তম জন্মদিনের কেক কেটেছেন করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে প্রথম দফায় লকডাউন থাকার সময়ে, গত ২ মে। এরপর ২১ জুলাই তাঁকে একাডেমি থেকে মূল দলের জন্য নিবন্ধিত করেছে সান্তোস। বিখ্যাত সাদা-কালো জার্সিটা গায়ে অভিষেক ২০ আগস্ট, লিগে স্পোর্ত রেসিফের বিপক্ষে। মাসখানেক না পেরোতেই দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বসূচক টুর্নামেন্ট কোপা লিবার্তাদোরেসেও অভিষেক হয়ে গেল।

দিন বিশেক পর ৪ অক্টোবর সান্তোসের জার্সিতে গোলও পেয়ে গেলেন লিওনার্দো, লিগে গোইয়াসের বিপক্ষে দলের জয়সূচক গোল সেটি। তার ১৬ দিন পর আবার গোল, এবার লিবার্তাদোরেসে আর্জেন্টিনার ক্লাব দিফেন্সা ই জুস্তিসিয়ার বিপক্ষেও ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার স্ট্রাইকারের গোলটা হয়ে থাকল সান্তোসের জয়সূচক।

নেইমার, গাবিগোল, রদ্রিগোদের উত্তরসূরি হিসেবে গত এক দশকে সান্তোসের একাডেমি থেকে এসে ক্লাবের জার্সিতে লিওনার্দো এভাবে আরও অনেক দিন আলো ছড়াতে পারবেন কি না, তা সময় বলবে। তবে এরই মধ্যে তাঁর দাম বেশ উঁচুতেই বেঁধে দিয়েছে সান্তোস। চুক্তিতে ‘রিলিজ ক্লজ’ রেখেছে ১০ কোটি ইউরো! অর্থাৎ, অন্য কোনো ক্লাব সান্তোসের অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিওনার্দোকে কিনতে চাইলে ১০ কোটি ইউরো খরচ করতে হবে!

পেলে তো পঞ্চাশ-ষাটের দশক রাঙিয়েছেন, এই শতকের শুরুর দিকে ছিলেন রবিনিও, এরপর সান্তোসের জার্সিতে গত এক দশকে আলো ছড়িয়েছেন নেইমার, গাবিগোলখ্যাত গাব্রিয়েল বারবোসা কিংবা রদ্রিগোরা। তবে এই দশকের বাকি তিনজনের চেয়ে একটা দিকে এগিয়ে লিওনার্দো। ২০১৪ সালে ১১ বছর বয়সে সান্তোসের যুব একাডেমিতে যোগ দেওয়ার পর একাডেমির বিভিন্ন দলে ১০০-র বেশি গোল লিওনার্দোর, যে কীর্তি ছিল না নেইমার-গাবিগোল-রদ্রিগোদের।

এরই মধ্যে বেশ নাম কুড়িয়েছেন লিওনার্দো (ডানে)।
ছবি: টুইটার

সান্তোসের একাডেমি থেকে উঠে মূল দলে জায়গা করে নেওয়া তরুণদের সান্তোসের সমর্থকেরা আদর করে ডাকেন ‘মেনিনো দা ভিলা’। বাংলায় অর্থটা অনেকটা দাঁড়ায় গ্রামের বা ঘরের ছেলে। সান্তোসের নতুন এই ঘরের ছেলে এখনো মূল দলে জায়গা পাকা করে নিতে পারেননি। এখন পর্যন্ত ক্লাবের জার্সিতে যে ১২টি ম্যাচ খেলেছেন, তার ১১টিতেই নেমেছেন বদলি হিসেবে। কিন্তু এস্তাদিও উরবানো কালদেইরার দর্শকেরা ১৭ বছর বয়সী তরুণের নামে গান বাঁধতে খুব বেশি সময় লাগবে না, এমনটাই অনুমান ব্রাজিলে!

ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব দিকে বাহিয়া রাজ্যের শহর ইতাপেতিঙ্গায় জন্ম লিওনার্দোর। বাবার হাত ধরে ফুটবলে খড়ি পাতা। তাঁর প্রতিভা বুঝতে পেরেই কি না, লিওনার্দো ছোট থাকার সময়েই ইতাপেতিঙ্গা থেকে ৯৫০ মাইল দূরে সাও পাওলোতে চলে আসে লিওনার্দোর পরিবার, যাতে লিওনার্দোর জন্য ব্রাজিলের বড় ক্লাবগুলোয় ট্রায়ালে সুবিধা হয়। সান্তোসের স্কাউটদের নজরে পড়তে সময় লাগেনি লিওনার্দোর, ১১ বছর বয়সেই তাই তাঁর ঠিকানা সান্তোসের বিখ্যাত একাডেমি।

সে বয়সেই দুই বছরের বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৩ দলে খেলা শুরু করেন লিওনার্দো। ‘দেখলাম ওর মধ্যে গোল খুঁজে নেওয়ার প্রতিভা আছে, সব সময় গোলের সুযোগ খোঁজে, ঠিক জায়গামতো থাকে’—সান্তোসের ওয়েবসাইটে লিওনার্দোকে নিয়ে বলেছেন ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১৩ দলের কোচ গুস্তাভো রোমা।

লিওনার্দোর খেলার ধরনের বর্ণনা পাওয়া যাবে তাঁর কথায়, ‘দারুণ ফিনিশার ও। প্রতি ম্যাচের প্রতিমুহূর্তে তৎপর থাকে। খুব ছোটাছুটি করে, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে তাড়া করে। বল ওর কাছে আসবে ভেবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, বরং গোল করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গায় যাওয়ার জন্য মুভ করতে থাকে সব সময়। সে কারণেই ও এত গোল করতে পেরেছে।’

মূল স্ট্রাইকার হিসেবে বয়সভিত্তিক দলগুলোয় লিওনার্দোর গোল করার প্রতিভার তুলনা হয় ২০১৩ সালে সান্তোসের একাডেমি থেকে উঠে মূল দলের জার্সিতে আলো ছড়ানো গাব্রিয়েল বারবোসা বা গাবিগোলের সঙ্গে। নেইমার ও গাব্রিয়েল জেসুসের সঙ্গে মিলে ব্রাজিলকে ২০১৬ রিও অলিম্পিকে সোনা এনে দেওয়া গাবিগোলের কীর্তিও ছাড়িয়ে যাবেন লিওনার্দো, দক্ষিণ আমেরিকার পর ইউরোপেও সফল হবেন—এমনই আশা সান্তোসে।

গত জুলাইয়ে তাঁকে মূল দলের সঙ্গে অনুশীলনে ডাকার পর সে সময়ে সান্তোসের মূল দলের কোচ জেসুয়ালদো ফেরেইরা বলেছিলেন, লিওনার্দো ‘সান্তোসের একাডেমির সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন’।

এরপর থেকে সান্তোসের হয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে যেভাবে খেলছেন, তাতে এখন পর্যন্ত লিওনার্দোর প্রশংসা শুধু বাড়ছেই! ক্লাবের জার্সিতে পঞ্চম ম্যাচেই গোইয়াসের বিপক্ষে ৩-২ গোলে জয়ের ম্যাচে দলের তৃতীয় গোলটি করলেন বেঞ্চ থেকে নেমে। ছয় গজের বক্সের ভেতরে নিচে হয়ে আসা ক্রসে প্রথম স্পর্শেই যেভাবে গোল করলেন, শিরোনামে আসতে সময় লাগেনি লিওনার্দোর।

এরপর দিফেন্সার বিপক্ষে লিবার্তাদোরেসে সান্তোসের ২-১ গোলে জয়ের ম্যাচে লিওনার্দোরের পরের গোলটিও প্রায় একই ঢঙে। সান্তোসের দ্বিতীয় ও জয়সূচক সেই গোল এসেছেও ম্যাচের ৯০তম মিনিটে। মাত্র ১৭ বছর ১৭৩ দিন বয়সে গোলটি করে মহাদেশীয় ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্টটির ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হয়ে যান লিওনার্দো, ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে চতুর্থ সর্বকনিষ্ঠ।

এরই মধ্যে আওয়াজ উঠছে, কোনো একদিন ব্রাজিলের ৯ নম্বর জার্সিটা গায়ে চাপাবেন লিওনার্দো। সান্তোসের বর্তমান কোচ কুচা অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই রাশ টানতে চান লিওনার্দোকে নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাসে, ‘অবশ্যই মার্কোস লিওনার্দো অসাধারণ একজন খেলোয়াড় হতে পারে, তবে ওর বয়স এখন মাত্র ১৭। এখনো মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে বেড়ে উঠছে ও। এই বয়সেই একজনকে দলের নেতা বানিয়ে দিতে পারি না আমরা।’

তবে লিওনার্দোকে সান্তোস কীভাবে মূল্যায়ন করে, তার প্রমাণ তো ২০২২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী তাঁর বর্তমান চুক্তিতে ১০ কোটি ইউরোর রিলিজ ক্লজই দেয়!