‘নাটুকে’, ‘পাগুলে’ এক রাত...

রাতে নাটকের যবনিকা পড়ল এমবাপ্পের টাইব্রেকার মিস দিয়েছবি: রয়টার্স

সকালে অফিস থাকে বলে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান অনেকে। তবে খেলাপাগল মানুষেরা যান একটু আফসোস নিয়েই। ভোর রাত পর্যন্ত জেগে খেলা দেখে সকালে অফিসে ছোটাটা যে বেশ শক্ত। এই যে ইউরো হচ্ছে, কত মানুষেরই তো রাত জেগে খেলা দেখার ‘বিলাসিতা’ করা সাজে না। কিন্তু আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে এমন মানুষদের আক্ষেপ-আফসোস একটু বেশিই হওয়ার কথা। ফুটবলপ্রেমীদের জিবে জল আনা এক রাতই যে ছিল কাল!

৮ গোলের থ্রিলার ছিল ক্রোয়েশিয়া–স্পেন ম্যাচ।
ছবি: রয়টার্স

রাত ১০টায় শুরু হয়েছিল স্পেন-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ। কেবল এই ম্যাচটিই গত রাতকে স্মরণীয় করে রাখতে যথেষ্ট। কিন্তু রাত বেড়ে চলার সঙ্গে আরও বড় রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছিল। ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড ম্যাচটিও যে স্নায়ুচাপ সামলানোর রুদ্ধশ্বাস পরীক্ষা নিল। দুটি ম্যাচই নির্ধারিত সময়ে ৩-৩ গোলে ড্র। স্পেন ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে বাজিমাত করে ফেলে ৫-৩ গোলে জিতে। কিন্তু সুইজারল্যান্ড ফ্রান্সের বিপক্ষে জিতেছে টাইব্রেকার-উত্তেজনার শেষে। কালকের রাতটা যেন তেমনই এক রাত, যে রাতটা বুঝিয়ে দিয়েছে ফুটবলে সবকিছুই সম্ভব। অফিস কিংবা সকালে ওঠার বাধ্যবাধকতার কারণে যদি কোনো ফুটবলপ্রেমী কাল রাতের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেন, তাঁর জন্য সমবেদনা।

শেষ ৫ মিনিটে দুর্দান্ত ‘কামব্যাক’ ক্রোয়েশিয়ার।
ছবি: রয়টার্স

দুই ম্যাচ মিলিয়ে ১৪ গোল। এর সঙ্গে টাইব্রেকারে পাগল করা উত্তেজনা—ফুটবলে এর চেয়ে বেশি কী আর চাওয়ার থাকতে পারে? মাঠে নাটকীয়তা দর্শকদের আরাধ্য, সেটি যে এভাবে ধরা দেবে, তা কে জানত! মোটকথা, ফুটবল-সুধা প্রাণভরে উপভোগের একটা রাত ছিল কাল। যাঁরা এমন রাতের সাক্ষী হলেন, তাঁরা যে ভাগ্যবান, সেটি না বললেও চলছে।

৮৫ মিনিট পর্যন্ত যে ম্যাচে ৩–১ গোলে এগিয়ে ছিল স্পেন, সে ম্যাচই অতিরিক্ত সময়ে তাদের জিততে হলো ৫–৩ গোলে!
ছবি: রয়টার্স

‘টাইব্রেকার’ রোমাঞ্চে সঙ্গী হলো কিলিয়ান এমবাপ্পের পেনাল্টি মিস। সেটি দিয়েই ভেঙেছে নাটকের মিলনমেলা। একসময় দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোয় সিনেমা দেখে ‘পয়সা উশুল’ হলো কি না, এমন আলোচনা হতো। সিনেমা দেখে দর্শকেরা যদি বলতেন পয়সা উশুল, তা হলেই নির্ধারিত হতো এর বক্স-অফিস সাফল্য। কাল রাতে এমবাপ্পের পেনাল্টি মিসে প্রাণভরে ফুটবল-সুধা পানের পর বুকের মাঝের সুখের ব্যথা কিংবা বিরহ দহনের অনুভূতি পেয়েছেন দর্শকেরা।

ফেবারিট ফ্রান্সের বিদায়
ছবি: রয়টার্স

অথচ, কালকের দুটি ম্যাচই দর্শকদের ‘অবশ্য দ্রষ্টব্য’ তালিকায় থাকার কথা নয়। স্পেন-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটি তা-ও কিছুটা হলেও, ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড তো একেবারেই নয়। এ ম্যাচে ফ্রান্স সহজেই জিতবে, এ কথা বলেছেন অনেকেই। কিন্তু সে ম্যাচটাই উপহার দিল সবচেয়ে বড় রোমাঞ্চ। স্পেন-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটি দেখতে দেখতে ৮৫ মিনিটে ‘চ্যানেল বদলে’ ফেলেছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ৮৫ মিনিট পর্যন্ত একটা ম্যাচে ৩-১ গোল কোনো দল এগিয়ে আছে, সে ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ে যাবে—এটা ভাবাই তো বাড়াবাড়ি! ফুটবল খেলার ‘রাজা’ বলেই বোধ হয় সেই ভাবনাটা মোটেও বাড়াবাড়ি মনে হয়নি।

সুইজারল্যান্ড ফ্রান্সকে হারাবে কে ভেবেছিল!
ছবি: রয়টার্স

ফ্রান্স বনাম সুইজারল্যান্ড—ম্যাচটা শুরুর দিকেই রোমাঞ্চের ইঙ্গিত দিয়েছে। এটি যেন স্পেন-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচেরই পুনর্মঞ্চায়ান! ১৫ মিনিটে হ্যারিস সেফারোভিচের গোল সুইজারল্যান্ডে এগিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মরিয়া ফ্রান্স খেলায় ফেরে ৫৭ মিনিটে, করিম বেনজেমার গোলে। এর মধ্যে ফরাসি অধিনায়ক উগো লরিস ত্রাণকর্তা হয়ে উঠলেন পেনাল্টি ঠেকিয়ে। ৫৯ মিনিটে বেনজেমা আবার গোল করার পর দর্শকদের অনেকেই ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন। পল পগবা যখন ৭৫ মিনিটে ফ্রান্সকে ৩-১ গোলে এগিয়ে নিলেন, তখন সকালের অফিসগামী ফুটবল-দর্শকেরা যদি টিভি বন্ধ করে দিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে গিয়ে থাকেন, তাঁদের খুব দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু সেফারোভিচ ৮১ মিনিটে আবার গোল করার পর মারিও গাভরানোভিচ যখন ৯০ মিনিটে সমতা ফিরিয়ে আনলেন, তখন নাটক জমে উঠেছে। কিন্তু নাটকটা যে উত্তুঙ্গ রোমাঞ্চ ছড়িয়ে শেষ হবে, শেষ দৃশ্যে এমবাপ্পে যে এভাবে ‘ভিলেন’ হিসেবে আবির্ভূত হবেন, সেটা যেকোনো দর্শকের জন্যই কল্পনার সর্বোচ্চ পর্যায়।

ফুটবল অনেক সময় ‘রূপকথা’ হয়ে ওঠে, কালকের রাতটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।