ইউরোর শুরুতেই শঙ্কার কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল ফুটবলপ্রেমী মানুষের মন।
ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথমার্ধে সেদিন হঠাৎ মাঠে লুটিয়ে পড়েন ডেনমার্কের ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল তাঁর। মাঠে জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জিতে ফেরেন এরিকসেন। মাঠ থেকে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, সেখানে সপ্তাহখানেক পর অস্ত্রোপচার হয়েছিল তাঁর। এখন এরিকসেন বাসায় ফিরেছেন।
তা যে যন্ত্রের ব্যবহার সেদিন এরিকসেনের জীবন বাঁচিয়েছিল, সেটিকে আরও বেশি করে মানুষের কাজে লাগানোর আলোচনা সেদিনের পর থেকেই উঠেছে চারদিকে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ সে দাবিতে সাড়া দিয়েছে।
অন্তত দুই হাজারটি ফুটবল মাঠে এরিকসেনকে বাঁচানো ‘অটোমেটেড এক্সটার্নার ডিফিব্রিলেটর’ (এইডি) নামের এই যন্ত্র রাখার কাজে নামছে প্রিমিয়ার লিগ। ইংল্যান্ডের ফুটবল ফাউন্ডেশন ও ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন—এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে এইডি সরবরাহের কাজে আর্থিক অনুদান দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইংল্যান্ডের শীর্ষ স্তরের লিগ আয়োজক কর্তৃপক্ষ।
১২ জুন ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে এরিকসেন মাঠে লুটিয়ে পড়ার পর প্রথমে ডেনমার্কের অধিনায়ক সিমন কিয়ের এসে তাঁকে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন, বুকে হাত দিয়ে চেপে হৃদ্যন্ত্র সচল করার চেষ্টা) দেন। ততক্ষণে ডেনমার্কের চিকিৎসক দলও চলে আসে মাঠে। ডিফিব্রিলেটর দিয়ে এরিকসেনের হৃদ্যন্ত্রের কাজ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন তাঁরা।
এরপর থেকেই আলোচনা ওঠে, এই যন্ত্রটা যত বেশি সম্ভব জনগণের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য রাখা হোক। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট তো যেকোনো সময়ই হতে পারে, সে সময় যাতে জীবন বাঁচানো এই যন্ত্র হাতের কাছে পাওয়া যায়—এটাই ছিল আলোচনার মূল দাবি। অন্তত ফুটবল মাঠে এই যন্ত্র হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করতে চাইছে প্রিমিয়ার লিগ।
দুই ধাপে অনুদান সরবরাহের কাজ করবে প্রিমিয়ার লিগ। ইংল্যান্ডের ফুটবল ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে যেসব মাঠ তৈরি করা হয়েছে, তার বেশির ভাগেই এখনো এইডি যন্ত্র নেই। প্রথম ধাপে এই মাঠগুলোতে যন্ত্রটি সরবরাহের কাজে হাত দেবে প্রিমিয়ার লিগ।
ইংল্যান্ডের ফুটবল ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে যেসব মাঠ তৈরি করা হয়েছে, তার বেশির ভাগেই এখনো এইডি যন্ত্র নেই। প্রথম ধাপে এই মাঠগুলোতে যন্ত্রটি সরবরাহের কাজে হাত দেবে প্রিমিয়ার লিগ।
দ্বিতীয় ধাপে মনোযোগ দেওয়া হবে নিজ অর্থায়নে চলতে থাকা ইংল্যান্ডের তৃণমূলের ক্লাবগুলোর দিকে। এই ক্লাবগুলোর মধ্যে যারা প্রিমিয়ার লিগের কাছে অর্থায়নের জন্য আবেদন করবে, তাদের অর্থ দেওয়া হবে, যাতে তারা নিজেদের মতো করে এইডি কিনে নিতে পারে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই ক্লাবগুলোতেও ডিফিব্রিলেটর সরবরাহ করা হবে বলে অনুমান লিগ কর্তৃপক্ষের।
প্রিমিয়ার লিগের প্রধান নির্বাহী রিচার্ড মাস্টার্স এ নিয়ে বলেছেন, ‘উয়েফা ইউরো ২০২০-এ ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ায় শঙ্কা ছড়িয়ে যাওয়া যে ঘটনার সাক্ষী হয়েছি আমরা, সেটি ফুটবল সমাজকে ডিফিব্রিলেটরকে আরও সহজলভ্য করার দিকে মনোযোগী হতে বলে। ফুটবল খেলোয়াড় ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার ভালো থাকাই সবার আগে বিবেচ্য। আর এই অর্থায়ন ফুটবল মাঠ ব্যবহার করা মানুষের কাছে এই যন্ত্রটি (এইডি) পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি যন্ত্রটির ব্যবহার শেখানোতেও সাহায্য করবে।’
যন্ত্রটি কীভাবে মানুষকে সাহায্য করবে, সেটিও ব্যাখ্যা করলেন মাস্টার্স, ‘দুর্ভাগ্যবশত, যে কারও, যেকোনো জায়গায়ই হঠাৎ করে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। আমাদের আশা, এই যন্ত্রটি আরও বেশি মাঠে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারব।’
এরিকসেনের আগে মাঠে এভাবে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ার ঘটনা ২০১২ সালে ইংলিশ ফুটবলও দেখেছে। বোল্টন ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলতে গিয়ে সেদিন মাঠে লুটিয়ে পড়েছিলেন ফ্যাব্রিস মুয়াম্বা। জীবন বাঁচলেও পরে আর ফুটবলে ফেরা হয়নি মুয়াম্বার।
প্রিমিয়ার লিগের এই পরিকল্পনার সমর্থনে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন মুয়াম্বা, ‘হাজারো তৃণমূল ফুটবল ক্লাবে ডিফিব্রিলেটর কেনার অর্থায়নে প্রিমিয়ার লিগের এই পরিকল্পনার একজন বড় সমর্থক আমি। এ ধরনের যন্ত্র সহজলভ্য হওয়ার গুরুত্ব কী, হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার কারও বাঁচার ক্ষেত্রে এই যন্ত্রের গুরুত্ব কী, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই আমি সেটা জানি।’
তবে শুধু যন্ত্রটা সরবরাহ করলেই তো কাজ শেষ নয়, সেটির ব্যবহারও সাধারণ্যে শেখানোর গুরুত্বের কথা বললেন মুয়াম্বা, ‘ডিফিব্রিলেটর কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটা মানুষকে শেখানোও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, ক্লাবগুলো, মাঠগুলোর দায়িত্বে থাকা মানুষ যত বেশি সম্ভব কোচ, খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফকে এই যন্ত্রের ব্যবহার শেখানোর ট্রেনিং দেবে, যাতে আমাদের সবার ভালোবাসার এই খেলাটার মাঠ সবার জন্য আরও নিরাপদ জায়গা হয়ে ওঠে।’