২৩ হাজার টাকা বেতনের চাকরি সাত দিনও টিকল না

রবিনিওর পুরোনো পাপ এখনো তাঁকে তাড়া করে ফিরছেছবি: টুইটার

এ জন্যই হয়তো বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না!

দিন সাতেক আগে ফুটবল রোমান্টিকদের মনে বেশ নাড়া দিয়ে গিয়েছিল রবিনিওর শৈশবের ক্লাব সান্তোসে ফেরার খবর। শিরোনামে এসেছিল ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের বেতনও। এক সময়ে রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলানের মতো ক্লাবে লাখো ইউরো কামানো রবিনিও যে সান্তোসে ফিরেছিলেন মাত্র ২৭১ ডলার মাসিক বেতনে। বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২ হাজার ৯৮০ টাকার মতো।

কিন্তু এত কম বেতনের ‘চাকরি’টা এক সপ্তাহও টিকল না! ৩৬ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ানের সঙ্গে কাল চুক্তি বাতিল করেছে সান্তোস। কারণ? রবিনিও যে ধর্ষণের মামলায় শাস্তি পাওয়া আসামি!

২০১৩ সালে ইতালির নৈশক্লাবে আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত ২৩ বছর বয়সী এক মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল রবিনিওর বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালে সেটির রায়ে ৯ বছর জেলের সাজা জোটে রবিনিওর ভাগ্যে।

তখন থেকেই ইতালিতে আর যাচ্ছেন না রবিনিও, গেলেই যে জেলে যেতে হবে! এমন কুৎসিত কাজের সঙ্গে জড়িত একজনের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সান্তোস, তা যতই রবিনিও ক্লাবটির ‘ঘরের ছেলে’ হোন! অবশ্য রবিনিওর শাস্তির কথা জেনেও প্রথমে চুক্তিটা কেন করেছিল সান্তোস, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সে যা-ই হোক, চুক্তি বাতিল হয়েছে। সেটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কাল জানিয়ে বিবৃতিতে ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটি লিখেছে, ‘সান্তোস ও রবিনিও জানাচ্ছে, পারস্পরিক সম্মতিতেই দুই পক্ষ গত ১০ অক্টোবর সই করা চুক্তি বাতিল করেছে, যাতে খেলোয়াড় (রবিনিও) ইতালিতে চলতে থাকা বিচার প্রক্রিয়ায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করায় পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারেন।’ রবিনিও নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওতে চুক্তি বাতিল হওয়ায় অনুতাপ করেছেন। সঙ্গে বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল ‘সান্তোসকে সাহায্য করা।’

মুখে হাসি নিয়েই রবিনিও সান্তোসে ফিরেছিলেন সাত দিন আগে
ছবি: টুইটার

‘আমি যদি কারও জন্য কোনো ঝামেলার কারণ হয়ে থাকি, তাহলে আমার চলে যাওয়াই ভালো। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোতে মনোযোগ দেওয়াই উচিত। আমি যে নির্দোষ, পেইজাওয়ের (সান্তোসের ডাকনাম) সমর্থকদের কাছে আর যাঁরা আমাকে পছন্দ করেন তাঁদের কাছে সেটা প্রমাণ করব আমি’—বলেছেন রবিনিও।

কিন্তু বেতন পরের বিবেচ্য, ধর্ষণের মামলায় সাজা পাওয়া একজনকে ক্লাবে ফেরানোর পর থেকেই চারিদিক থেকে সমালোচনার মুখে পড়ে সান্তোস। এমনিতেই ক্লাবটার আর্থিক অবস্থা বেশ সঙিন, তার মধ্যে রবিনিও আসায় গত বুধবার সান্তোসের এক স্পনসর অর্থোপ্রাইড চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা দেয়। ‘নারীর প্রতি সম্মান’ দেখাতেই ধর্ষণের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত রবিনিওর ক্লাবের স্পনসরশিপ বাতিল করেছে অর্থোপ্রাইড।

এর মধ্যে গতকাল ব্রাজিলিয়ান সংবাদপত্র গ্লোবোস্পোর্তে একটি টেলিফোন কলের ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করে। রবিনিওর মামলার রায়ের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে এই টেলিফোন কল বিবেচনায় নিয়েছিলেন ইতালিয়ান বিচারক। যে রাতে ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল, সে রাতে মঞ্চে পারফরম করা সংগীতশিল্পী জাইরো শাগাসের সঙ্গে রবিনিওর কথা হয়েছিল সেই কলে।

আলাপের একপর্যায়ে মামলার তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে রবিনিওর কাছে শাগাস উদ্বেগ প্রকাশ করেন, সেটির জবাবে রবিনিও বলেছিলেন, ‘মেয়েটা তো পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত ছিল, সে তো ঠিক করে বলতেই পারবে না কী হয়েছে!’ আরেক কলে রবিনিও স্বীকার করেছেন, তিনি ওই মেয়ের সঙ্গে সঙ্গমের চেষ্টা করেছিলেন।

একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় নক্ষত্রের পতন কত বাজেভাবে হতে পারে, সেটির উদাহরণই হয়তো হয়ে থাকবে রবিনিওর ক্যারিয়ার। পেলের ক্লাব সান্তোসে শুরুতে এতটাই ঝলক দেখিয়েছিলেন যে, পেলের উত্তরসূরিও ভাবা হতো তাঁকে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই রিয়াল মাদ্রিদের ট্রেনও চলে আসে তাঁর ক্যারিয়ারের জংশনে। জিদান-বেকহাম-রাউলদের রিয়ালে ‘১০’ নম্বর জার্সিটাও তাঁর ভাগ্যেই জুটেছিল। কিন্তু অনেক ব্রাজিলিয়ানের মতো নৈশক্লাবের ছটা, নারীসঙ্গের লোভ আর অগোছালো জীবনের অভ্যাসে ঘুণ ধরল রবিনিওর ফুটবলে।

যে রবিনিও মানে স্টেপওভারের বিদ্যুচ্চমক, যে রবিনিও ছিলেন নেইমারের বেড়ে ওঠার দিনগুলোর নায়ক, সে রবিনিওই পরে হয়ে গেলেন এক নারীর বাস্তব জীবনের খলনায়ক। একটা জীবনের দুঃস্বপ্নের প্রতিশব্দ।

২০০৮ সালে রিয়াল ছেড়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে হতাশার দুই বছর কাটিয়েছেন-এর মধ্যে আবার ধারে ফিরেছিলেন সান্তোসেও, সিটি থেকে গেলেন এসি মিলানে। ইতালি থেকেও একবার অবশ্য ধারে সান্তোসে এসেছিলেন। তা মিলানে পাঁচ বছর থাকার সময়েই ওই নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছেন, মিলানের এক নৈশক্লাবে।

ইতালিতে সাজা পাওয়ার পর থেকে চীন-তুরস্ক-ব্রাজিলে এ ক্লাব-ও ক্লাবে কাটিয়েছেন। গত ১০ অক্টোবর সান্তোসে চতুর্থবারের মতো ফেরেন সান্তোসে। তখন তাঁর ফেরার চেয়েও বেতনই বেশি আলোচনায় এসেছিল। মাসে ২৬৫ ডলার বেতনও হয়তো পেতেন না। কিন্তু ব্রাজিলের আইন অনুযায়ী, একজন চাকুরে এর চেয়ে কম বেতনে কাজ করতে পারেন না।

তাঁর অতীতের পাপ সেই চাকরিটাকে সাত দিনও টিকতে দিল না!