৪ বছর পর মেসি ছাড়া অন্য কেউ

গোল না পেলেও বলিভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে দারুণ খেলেছেন মেসি।ছবি: রয়টার্স

কতটা স্বস্তি দিয়ে গেছে জয়টা, ম্যাচের পর লিওনেল মেসির অভিব্যক্তি তা স্পষ্ট বলে দিয়েছে। যত খেলোয়াড়, কোচ, দলের অন্যান্য সদস্য...কাকে জড়িয়ে ধরতে বাদ রেখেছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক!

হতে পারে জয়টা বলিভিয়ার বিপক্ষে, হতে পারে বলিভিয়া তর্কসাপেক্ষে দক্ষিণ আমেরিকার দুর্বলতম দল, কিন্তু এই ম্যাচে বলিভিয়ার চেয়েও আর্জেন্টিনার বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল উচ্চতা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে তিন হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতায় বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজের এই স্টেডিয়াম আর্জেন্টিনার জন্য সব সময়ই বড় পরীক্ষা হয়ে ছিল। মেসির জন্যও। তাতে অবশেষে জয়টা ধরা দিয়েছে। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে আজ বাংলাদেশ সময় ভোরে বলিভিয়ার মাঠ থেকে ২-১ গোলের জয় নিয়ে ফিরেছে আর্জেন্টিনা।

জয়ের পাশাপাশি আরেকটা ‘অর্জন’ও হয়েছে আর্জেন্টিনার—প্রায় চার বছর পর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আকাশি-সাদা জার্সিটাতে মেসি ছাড়া কাউকে গোল করতে দেখল আর্জেন্টিনা!

বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চার বছর পর মেসি ছাড়া আর্জেন্টিনার জার্সিতে গোল করা প্রথম ফুটবলার হলেন মার্তিনেজ (ডানে)।
ছবি: রয়টার্স

বলিভিয়ায় গিয়ে খেলা কতটা বড় চ্যালেঞ্জ দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশগুলোর জন্য, সেটি সম্ভবত এখন সর্বজনবিদিত। পর্বতসমান উচ্চতার ওই স্টেডিয়ামে সুন্দর ফুটবল তো পরের হিসাব, দম রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক মিনিট দৌড়ালেই অক্সিজেনের অভাবে পড়ে যায় অত উচ্চতায় অনভ্যস্ত ফুসফুস। সঙ্গে বাতাসে বলের গতিপথে উল্টোপাল্টা বদল তো আছেই! বলিভিয়া দল হিসেবে অতটা শক্তিশালী হয়তো নয়। কিন্তু নিজেদের মাঠে এই দলটাই হয়ে যায় কঠিন প্রতিপক্ষ। তাদের বিপক্ষে ধুঁকতে হয় প্রায় সব দলকেই।

আর্জেন্টিনা সব সময়ই ধুঁকেছে মাঠটাতে। আজকের জয়টা বলিভিয়ার মাটিতে ২০০৫ সালের মার্চের পর আর্জেন্টিনার প্রথম। ২০০৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সেই ম্যাচেও আর্জেন্টিনা জিতেছিল ২-১ গোলে। শুধু কি আর্জেন্টিনার জন্য? মেসির জন্য ব্যক্তিগতভাবেও বলিভিয়ার এই মাঠ যে অপয়া। এই মাঠেই তিনি ২০০৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে লজ্জার হার দেখেছিলেন। সে ম্যাচে আর্জেন্টিনা হেরেছিল ৬-১ গোল। ২০০৫ সালের আগস্টে আর্জেন্টিনা দলে অভিষিক্ত মেসি এই প্রথম বলিভিয়ার মাঠে দেখলেন দেশের জয়।

এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ২০১৩ সালের মার্চে আর্জেন্টিনা করেছিল ১-১ ড্র, সে ম্যাচেও দলে ছিলেন মেসি। ২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলতে ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বলিভিয়ায় গিয়ে ২-০ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা, সে ম্যাচে অবশ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে মেসি দলে ছিলেন না। সব মিলিয়ে বলিভিয়ার মাটিতে কখনো জেতা তো হয়ইনি মেসির, কখনো গোলও পাননি। ৩৩ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড গোল পাননি কালও, কিন্তু দারুণ খেলেছেন।

কিন্তু মেসি গোল না পেলেও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে মেসি ছাড়া কেউ গোল করতে না পারার খরাটা তো কেটেছে। সেই ২০১৬ সালের নভেম্বরে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়ের ম্যাচে মেসির পাশাপাশি দি মারিয়া ও লুকাস প্রাত্তো গোল করেছিলেন, এরপর থেকে কালকের আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনা খেলেছে ৭টি ম্যাচ। তাতে গোলই করেছে ৬টি, তার ৫টিই মেসির। অন্য গোলটি ভেনেজুয়েলার রলফ ফেলতশেরের আত্মঘাতী।

চার বছর আগে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ওই ম্যাচের চিলির বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতেছে আর্জেন্টিনা, সেই গোলটি করেছেন মেসি। কিন্তু চিলির বিপক্ষে ওই ম্যাচে সহকারী রেফারিকে গালি দেওয়ার অভিযোগে মেসিকে চার ম্যাচ নিষিদ্ধ করে ফিফা, যে কারণে বলিভিয়ার বিপক্ষে ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের পরের সেই ম্যাচে (২-০ গোলে হার আর্জেন্টিনার) খেলতে পারেননি আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। কিন্তু আর্জেন্টিনার আপিলের পর ফিফার আপিল কমিটি রায় পুনর্বিবেচনা করে, যথাযথ প্রমাণ না পাওয়ায় মেসির নিষেধাজ্ঞা চার ম্যাচ থেকে নামিয়ে আনে এক ম্যাচে। বলিভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেই যেটি শেষ হয়ে যায়।

উরুগুয়ের বিপক্ষে বাছাইপর্বের পরের ম্যাচে ফেরেন মেসি। কোচ হিসেবে আর্জেন্টিনার ডাগআউটে হোর্হে সাম্পাওলির অভিষেক ম্যাচ ছিল সেটি। গোলশূন্য ড্র হয় সেই ম্যাচ। তার পরের ম্যাচ ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র, আর্জেন্টিনার হয়ে গোলটি ছিল ফেলতশেরের আত্মঘাতী। পেরুর বিপক্ষে পরের ম্যাচটিও গোলশূন্য ড্র করে আর্জেন্টিনা। আর এর পরের ম্যাচ তো মেসির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত ম্যাচগুলোরই একটি।

বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শেষ সেই ম্যাচে সরাসরি বিশ্বকাপে যাওয়া নিশ্চিত করতে ইকুয়েডরের প্রায় ২ হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতার স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনাকে জিততেই হতো, সেখানে প্রথম মিনিটেই পিছিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা! সেখান থেকে মেসির দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে আর্জেন্টিনা জেতে ৩-১ গোলে। ইকুয়েডরের অত উচ্চতায় খেলা কতটা কঠিন, সেটা সম্ভবত কাল রাতে বুঝেছে লুইস সুয়ারেজের উরুগুয়েও, সুয়ারেজের জোড়া গোলের পরও ইকুয়েডরের মাটিতে ৪-২ গোলে হেরেছে উরুগুয়ে।

তা এবারের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ম্যাচ দিয়েই শুরু হয় আর্জেন্টিনার। মেসির পেনাল্টিতে কোনোরকমে ম্যাচটা জেতে লিওনেল স্কালোনির দল। এরপর এল কালকের ম্যাচ। মেসি গোল না পেলেও জিতেছে ২৪ মিনিটেই পিছিয়ে পড়া আর্জেন্টিনা। ৪৫ মিনিটে সমতা ফেরানো গোলটি লওতারো মার্তিনেজের, ৭৯ মিনিটে হোয়াকিন কোরেইয়ার গোলটি হয়ে থেকেছে জয়সূচক।

মার্তিনেজের গোলটিই ছিল ২০১৬ সালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের পর বাছাইপর্বে মেসি ছাড়া কোনো আর্জেন্টাইনের গোল। পরে অবশ্য আরেকটি ‘কীর্তি’ও গড়েছেন মার্তিনেজ। কোরেইয়ার গোলটিতে শেষ পাস বা অ্যাসিস্ট তাঁর। আর্জেন্টিনার জার্সিতে বাছাইপর্বে যেখানে মেসি ছাড়া কাউকে গোল করতে দেখাই দুর্লভ অভিজ্ঞতা, সেখানে মেসি ছাড়া কারও একই ম্যাচে গোল ও অ্যাসিস্ট? সে অভিজ্ঞতা ২০১৩ সালের ১১ অক্টোবরের পর এই প্রথম! মার্তিনেজের আগে সর্বশেষ এমন কীর্তি গড়েছিলেন রদ্রিগো পালাসিও, পেরুর বিপক্ষে।

মেসি বুঝি এ বেলায় আর্জেন্টিনার জার্সিতে একটু নির্ভার থাকতে পারছেন!