৭০ বছর আগে ডি স্তেফানোদের সুপার লিগও টেকেনি
ইউরোপিয়ান সুপার লিগ, ফুটবল–বিশ্বে যার আরেক নাম বিদ্রোহী লিগ। যাত্রা শুরুর আগেই মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে এই সুপার লিগ! তবে এমন বিদ্রোহী লিগ ফুটবল–বিশ্বে এটাই প্রথম নয়।
৭০ বছর আগে এমন এক বিদ্রোহী লিগের জন্ম দিয়েছিল কলম্বিয়া, যার নাম ছিল এল দোরাদো। স্প্যানিশ শব্দ দোরাদোর বাংলা মানে সোনালি। কলম্বিয়ার বিদ্রোহী লিগ বা সুপার লিগ এল দোরাদো সত্যই নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে জাঁকজমক আর পয়সাওয়ালা লিগ ছিল এটিই। শুধু কি পয়সার দিক থেকেই এগিয়ে ছিল এই লিগ? আলফ্রেডো ডি স্তেফানো, আডোলফো পেডেরনেরা, নেস্তর রসি, ভালেরিয়ানো লোপেজ, শার্লি মিটেন, হেলেনো ডি ফ্রেইতাস...সেই সময়ে সেরা খেলোয়াড়দের অনেকেই যে নাম লিখিয়েছিলেন কলম্বিয়ার বিদ্রোহী লিগে!
কিন্তু জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াইয়ে কি জেতা যায়! এল দোরাদো কর্তৃপক্ষও জিততে পারেনি। ফিফার চাপের কাছে হারতে হয়েছে তাদের। এত অর্থের এত জমকালো লিগটি টিকে ছিল মাত্র পাঁচ বছর।
১৯৪৯ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল এল দোরাদোর। সেই সময়ে বিভিন্ন লিগ থেকে এল দোরাদো কর্তৃপক্ষ খেলোয়াড়দের তাদের বিদ্রোহী লিগে ভিড়িয়েছিল তিন, চার বা পাঁচ গুণ বেশি বেতনের বিনিময়ে। এমন অর্থকরী একটি লিগের কথা খেলোয়াড়েরা সেই সময় স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তবে সেটা হয়ে গিয়েছিল কলম্বিয়ার ফুটবলে এক ঝামেলার পথ ধরে।
কলম্বিয়ার ফুটবল লিগ পেশাদারে পরিণত হয়েছে ১৯৪৮ সালে। কলম্বিয়ার পেশাদার ফুটবল লিগ যাত্রা শুরু করতে না করতেই কলম্বিয়ার ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে শুরু হয় ঝামেলা। ফলে কলম্বিয়ার পেশাদার ফুটবল লিগ আয়োজক দিয়ামায়োর দেশটির ফুটবল ফেডারশনকে ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ফিফা কলম্বিয়ার ফুটবল লিগ নিষিদ্ধ করে। একই সময়ে আর্জেন্টিনার ফুটবল লিগে চলছিল খেলোয়াড়দের ধর্মঘট। আর্জেন্টিনার সিনিয়র আর গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের অনেকেই সেই সময় দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছিলেন।
পুরো বিষয়টির ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেন কলম্বিয়ার ক্লাব মিলোনারিওস এফসির চেয়ারম্যান আলফনসো সিনিয়র। তিনি সেই সময় দলে ভেড়ান বেশ কয়েকজন আর্জেন্টাইন ফুটবলার। প্রথমেই মিলোনারিওসে নাম লেখান আর্জেন্টিনার সেই সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার আডোলফো পেডেরনেরাকে। আলফনসো সিনিয়রের পথ অনুসরণ করে অন্য ক্লাবগুলোও যে যার মতো করে বিভিন্ন দেশের তারকা ফুটবলারদের দলে টানতে শুরু করে।
আতলেতিকো জুনিয়র দলে ভেড়ায় ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ফ্রেইতাসকে। একই সঙ্গে তারা চুক্তি করে হাঙ্গেরিয়ান লাসলো সোকেকে। মিলোনারিওস পরে আবার দলে টানে আর্জেন্টিনা ও রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি ফুটবলার ডি স্তেফানোকে। পরে ইতালির নেস্তর রসিও তাঁর সতীর্থ হয়েছিলেন মিলোনারিওসে।
সব মিলিয়ে কলম্বিয়ায় শুরু হয়ে যায় জমজমাট এক ‘বিদ্রোহী’ লিগ। যেটির নাম দেওয়া হয়েছিল এল দোরাদো। পরের বছরই অবশ্য ফিফা লিগের আয়োজক দিয়ামায়োরের সঙ্গে পেরুর রাজধানী লিমাতে এক বিশেষ আলোচনায় বসে। ফিফার সঙ্গে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করে তারা। সেই চুক্তি অনুযায়ী এল দোরাদোর বিদেশি খেলোয়াড়দের ১৯৫৪ সালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার শর্তও ছিল।
দিয়ামায়োরের এই চুক্তির ফলে ১৯৫৪ সালের মধ্যে বেশির ভাগ বিদেশি ফুটবলারই ছেড়ে দেয় কলম্বিয়ার লিগের দলগুলো। ফলে খুব দ্রুতই জৌলুস হারিয়ে ফেলে এল দোরাদো। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ডি স্তেফানো-ফ্রেইতাস-নেস্তরদের হারিয়ে একেবারেই অনুজ্জ্বল হয়ে যায় বিদ্রোহী লিগটি।
এমন একটি জমজমাট লিগ যে এত দ্রুত নিষ্প্রভ হয়ে যাবে, সেটা সেই সময়কার ফুটবলপ্রেমীদের পক্ষে ভাবাটা খুবই কঠিন ছিল।
‘হিস্ট্রি অব কলম্বিয়ান ফুটবল’–এর লেখক গিলের্মো রুইজ সেই সময়ের কথা মনে করে বলেছেন, ‘কেউ কখনোই ভাবেনি এমন বাজে অবস্থা হবে লিগটির। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের পেয়েছিল লিগটি। সেই সময় কলম্বিয়াতে বিশ্বের সেরা ক্লাবগুলো খেলতে আসত।’
এল দোরাদো তবু পাঁচ বছর বেঁচে ছিল। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ তো আলোর মুখ দেখার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ১২ দলের ১০টি এই লিগ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। যে দুটি বাকি রয়েছে, সেই রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনা কতক্ষণ নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।