অস্ত্রের 'বৈধ কাগজের' গেরোয় শুটাররা

অস্ত্রের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই শুটারদের। ছবি: প্রথম আলো
অস্ত্রের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই শুটারদের। ছবি: প্রথম আলো

 এখন থেকে অস্ত্রের বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে শুটিং করতে হবে শুটারদের। কিন্তু প্রায় কোনো শুটারেরই ব্যক্তিগত অস্ত্রের কাগজপত্র নেই

বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন নজিরবিহীন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৬ জুন ফেডারেশনের অনলাইন সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের ৪.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'ভবিষ্যতে ফেডারেশন কর্তৃক আয়োজিত বা প্রেরিত যেকোনো প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকালে সকল অস্ত্রের বৈধ কাগজ দেখাতে হবে।'

গত ২ ফেব্রুয়ারি একটি উড়ো চিঠি যায় শুটিং ফেডারেশন ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে। রাজধানীর সবুজবাগের একটি ঠিকানা উল্লেখ করে জনৈক আবদুল কাদের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, '২০১৮ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শুটিং দল দেশে ফেরত আসার সময় কতিপয় শুটার প্রায় ২০টি রাইফেল ও পিস্তল শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে আনে এবং উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে। এই শুটারগণ তাদের নিজস্ব ব্যবহারের অস্ত্রের আড়ালে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতি রক্ষা না করে চোরাচালান সম্পাদন করে।' চিঠিতে আটজন শুটার ও তাঁদের সংস্থার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। শুটিং ফেডারেশন অবশ্য বলছে, তাদের সিদ্ধান্ত এই চিঠির কারণে নয়।

তাহলে কেন হঠাৎ বৈধ কাগজপত্র দেখানোর নিয়ম? এত দিন তো কাগজপত্র দেখানো ছাড়াই শুটিং করে এলেন শুটাররা! শুটিং ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরীর ব্যাখ্যা, 'ফেডারেশনে সম্প্রতি কিছু বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাগজপত্র ছাড়া দেশে কিছু অস্ত্র এসেছে। অতীতে অস্ত্রের মালিকানা শুটিং ফেডারেশন কখনোই দেখতে চায়নি। এখন তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যাপারটা আসায় বৈধ কাগজ দেখাতে বলা ছাড়া উপায় নেই। সরকার এসব অস্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমরা জবাব দিতে পারব না।'

বৈধ কাগজ বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে, এ নিয়ে শুটারদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। ৩৬ বছর ধরে শুটিং ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত নাজিমউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'সেটা কোনো ক্যাশ মেমো হতে পারে। আমরা শুধু অস্ত্রের মালিকানার কাগজটা দেখতে চাই।' আর কাগজ দেখাতে না পারলে? এটা জটিল প্রশ্ন বলে নামিজউদ্দিনের পাল্টা প্রশ্ন, 'একটা অস্ত্রের কাগজপত্র না থাকলে ফেডারেশনের কী করা উচিত, আপনারাই বলুন?'

আকস্মিক শুটিং ফেডারেশনের এমন সিদ্ধান্তে একটু যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় শুটাররা। চাইলেও তাঁদের পক্ষে অস্ত্রের কাগজপত্র দেখানো সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে খেলা ৯৫ ভাগ খেলোয়াড়েরই নাকি কাগজপত্র নেই। দেশসেরা শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি, অর্ণব শাহরার, রিসালাতুল ইসলামসহ প্রায় সবারই একই অবস্থা। তবে তাঁরা কেউই এ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি। বাকির কথা, 'আমি আমার সংস্থার অনুমোদন ছাড়া এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না।' বাকি তাঁর বর্তমান রাইফেলটি ২০১৭ বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে জার্মানি থেকে আনেন।

শুটাররা অনেকেই বলছেন, তাঁরা অস্ত্র উপহার পেয়েছেন বিদেশে গিয়ে। কাজেই কাগজ নেই। তবে কেউ অস্ত্র উপহার পেলেও বৈধ কাগজপত্র থাকা উচিত বলে মনে করেন ফেডারেশন সভাপতি। এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষুব্ধ এক শুটারের প্রশ্ন, 'কর্মকর্তারা এত দিন কি ঘুমিয়ে ছিলেন?' কথাটা সভাপতিকে বলতে তিনিও মেনে নিলেন এই ক্ষোভ, 'প্রশ্নটা ঠিকই আছে। তবে অতীতে কেউ এভাবে অস্ত্র এনেছে কি না, আমার জানা নেই। এখন যেহেতু বিষয়টা জানতে পেরেছি, তাই ব্যবস্থা নিতেই হবে।' বেনামি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই কি এই সিদ্ধান্ত? সভাপতি বলছেন, 'না। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত। চিঠিটি আমি দেখেছি। ওটা এনবিআরে দিয়েছি।'

সম্প্রতি শুটিং ফেডারেশনের করা এক তদন্ত প্রতিবেদনের ৩৬ নম্বর পাতায় এ-ও বলা হয়েছে, 'শুটিং ফেডারেশনের মহাসচিব অবৈধভাবে জার্মানি থেকে ফেরার পথে শুটিং দলের সঙ্গে সাতটি এনসুজ এয়ার রাইফেল আনেন।' কিন্তু মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অভিযোগটি মানতে নারাজ। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, 'কথাটা সত্য নয়। এনসুজ এয়ার রাইফেল বলতে কোনো রাইফেল বাংলাদেশে আসেনি। এখন এসব কাগজপত্র চাওয়া মানে একটা অশান্তির সৃষ্টি করা। এমন কিছু আমাদের করা উচিত নয়, যাতে শুটারদের সমস্যা হয়। এয়ার রাইফেল যে কেউ এত দিন আনতে পারত। এটা অবৈধ ছিল না।'

সাবেক শুটার আসিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, ২০০৮-০৯ সালের দিকে সরকারের অনুমোদন নিয়ে তিনি জার্মানি থেকে একটি এয়ার রাইফেল আনেন। সে জন্য পাঁচ হাজার টাকা ট্যাক্সও দেন তিনি। এর আগে ২০০০ সালে অলিম্পিক গেমসের প্রশিক্ষণে জার্মানি গিয়ে সাবেক এক শুটার প্রথম ব্যক্তিগত অস্ত্র আনেন। তখন থেকেই খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগতভাবে অস্ত্র আনা শুরু। কিন্তু একপর্যায়ে এয়ার রাইফেলের ব্যবহারে দেশে পাখি শিকার বেড়ে যাওয়ায় এটির আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আসে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে সরকারের আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ বলা হয়েছে, 'এয়ারগান আমদানি নিষিদ্ধ। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ক্রীড়া ও শুটিং ক্লাবে এয়ারগান ব্যবহার করা যাবে।'

সব একপাশে রেখে শুটারদের এখন একটাই চিন্তা—বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারলে সামনে শুটিং করবেন কীভাবে।