পরিবারের হাল ধরার আশায় সুমাইয়া

বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী সুমাইয়া দেওয়ানছবি: প্রথম আলো

মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইউনিয়নের আলীনগর গ্রামটা বিখ্যাত পাটালি গুড়ের জন্য। খেজুরের রস দিয়ে বানানো এই গুড় পরিচিতি এনে দিয়েছে গ্রামটাকে। শহর থেকে অটোতে ১৫ মিনিটে দূরত্বে আলীনগর গ্রাম এখন পরিচিত এক তরুণীর কল্যাণেও। বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী সুমাইয়া দেওয়ান এই গ্রামেরই মেয়ে। গত ৩ জানুয়ারি দেশের টানা ১১ বারের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারকে হারিয়ে নিজের গ্রামকে আলোকিত করেছেন সুমাইয়া।

কিন্তু বাবা তজুমুদ্দিন দেওয়ান দেখে যেতে পারলেন না মেয়ের এত বড় সাফল্য। সুমাইয়ার জীবনে একটা বড় দুঃখ এটা। তাঁর বাবা তজুমুদ্দিন ৬৫ বছর বয়সে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০২০ সালে। রেখে গেছেন স্ত্রী সাজেদা বেগম ও তিন মেয়ে, যার মধ্যে সুমাইয়া সবার বড়।

তজুমুদ্দিন কৃষিকাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুতে সংসারে শূন্যতা দেখা দিয়েছে। জমিজমা যা আছে, সেটার আয় দিয়ে আপাতত সংসার চলছে। চাচা–মামারা মাঝেমধ্যে হয়তো কিছু সহায়তা করেন। কিন্তু পরিবারের বড় সন্তানের কাঁধে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসে পড়েছে সংসারের হাল ধরার চাপ।

ছোটবেলা থেকেই ট্রফি আর পদকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন সুমাইয়া
ছবি: সৌজন্য

ছোট কাঁধে পরিবারের সেই চাপ নিতে তৈরি হচ্ছেন দেশের দ্রুততম মানবী। কদিন আগে বিকেএসপিতে জাতীয় অ্যাথলেটিকস দলের অনুশীলনের ফাঁকে এই প্রতিবেদককে সেটাই বললেন তিনি, ‘এখন আমি বিকেএসপির একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আগামী বছর এইচএসসি পাস করে বের হব এখান থেকে। আপাতত ছাত্রী হওয়ায় এখন কোনো কিছু করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তবে আশা করি আস্তে আস্তে আরও ভালো খেলোয়াড় হতে পারব এবং একটা চাকরি পাব। চাকরি পেলে পরিবারের দেখাশোনা করতে পারব।’

অ্যাথলেটরা মাঠে ভালো করলে বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি পান। একটা চাকরিই তাঁদের জীবনের সহায় হয়। মূলত চাকরির আশায় অনেক ছেলেমেয়েই গ্রাম থেকে উঠে এসে খেলাধুলার খাতায় নাম লেখান। তবে এত কিছু ভেবে ছোটবেলায় খেলাধুলা করতেন না সুমাইয়া। বাবা-চাচারা এলাকায় ফুটবল খেলতেন। কিন্তু সুমাইয়া মনের আনন্দে স্কুলক্রীড়ায় ঝড় তুলতেন অ্যাথলেটিকসে। দৌড়ে সব সময়ই প্রথম হতেন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম পুরস্কার পান একটা প্লেট। তাতে উৎসাহ বাড়ে আরও।

সুমাইয়া পেছন ফিরে বলেন, ‘ছোট থেকে আমার আগ্রহ বেশি ছিল খেলাধুলায়। স্কুলে ১০০, ২০০, হাই জাম্প, লং জাম্প—সব ইভেন্টে প্রথম হতাম। সব সময় প্রথম হতে, পুরস্কার পেতে আমার ভালো লাগত। এখন আমার বাসায় অনেক পুরস্কার জমে গেছে।’
ছোট থেকেই খেলাটা হয়ে গেল তাঁর নেশা।

এভাবে আরও অনেক পদক জিততে চান দেশের নতুন দ্রুততম মানবী
ছবি: সৌজন্য

ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর গড়পাড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সুমাইয়া হিট দিতে পারলেন না। তখন তাঁর বাবা স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক আবদুর রহিমকে অনুরোধ করেন, মেয়েকে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ দিতে। শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেয়ে ১০০, ২০০ ও লং জাম্প—তিন ইভেন্টেই সেরা সুমাইয়া।

এতে স্কুল কর্তৃপক্ষের আশা অনেক বেড়ে যায় ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে। আন্তস্কুল প্রতিযোগিতায় অনেক ভালো করেন। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নজর কেড়ে দেশের শীর্ষ স্তরেও নিজেকে চিনিয়েছেন। গ্রামের সবার কাছে এখন তিনি চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি।

সুমাইয়া ছোট থেকে নাচতে পছন্দ করতেন। দুধ, পায়েস আর মিষ্টিজাতীয় খাবার পছন্দ তাঁর। তবে ঝাল খাবার একদম নয়। বই পড়তে ভালোবাসেন। ছোটবেলায় মুহাম্মদ জাফর ইকবালের আমিই তপু বইটি পড়ে আনন্দ পেয়েছেন। বাগান করা তাঁর পছন্দ। প্রিয় খেলোয়াড় জ্যামাইকার শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস।

বিকেএসপিতে অনুশীলনে মগ্ন সুমাইয়া (সামনে ডানে)
ছবি: প্রথম আলো

গড়পাড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সুমাইয়া থেকে দেশের দ্রুততম মানবী সুমাইয়া হওয়ার পথটা পেরোতে কষ্ট করতে হয়েছে অনেক। ২০১৭ সালে মানিকগঞ্জে ট্রায়াল দিয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার ঠিক আগে জাতীয় জুনিয়র পর্যায়ে ঢাকায় খেলেন খালি পায়ে। তাঁর তখন এক জোড়া কেডস বা রানিং শু ছিল না। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার আগে ৫০০ টাকা দিয়ে তাঁকে এক জোড়া কেডস কিনে দেওয়া হয় পরিবারের পক্ষ থেকে।

সুমাইয়া অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার কথা যখন, তখন এক বছর পিছিয়ে আবার সপ্তম শ্রেণিতে বিকেএসপিতে ভর্তি হন। গত পাঁচ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পেয়ে দেশের দ্রুততম মানবী হয়েছেন বিকেএসপিরই সাবেক ছাত্রী শিরিন আক্তারকে হারিয়ে।

টাইমিং ১২.৩২ সেকেন্ড। শিরিনের টাইমিং ১২.৩৬ সেকেন্ড। দুজনের টাইমিংই আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেকটা পেছনে। তবে ভবিষ্যতে টাইমিং আরও ভালো হবে আশা কোচ সুফিয়া খাতুনের, ‘সুমাইয়া ছোট মানুষ। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় ওর পারফরম্যান্স খারাপ নয়। ভালো প্রশিক্ষণ পেলে অনেক দূর যেতে পারে। কোনো সংস্থায় যদি চাকরি নেয় এবং মন দিয়ে খেলে তাহলে ভালো করবে। কিন্তু মন অন্য দিকে চলে গেলে সমস্যা। তাই নিজেকে সঠিক পথে রাখতে হবে।’

আপাতত ছাত্রী হওয়ায় এখন কোনো কিছু করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তবে আশা করি আস্তে আস্তে আরও ভালো খেলোয়াড় হতে পারব এবং একটা চাকরি পাব।
সুমাইয়া দেওয়ান, বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী

সঠিক পথে রাখতে সুমাইয়ার ভাষায় বিকেএসপিতে ‘সুন্দর ক্যাম্প’চলছে। যেখানে আছেন ১২ জন অ্যাথলেট। গতকাল থেকে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন অ্যাথলেটরা, প্রিয়জনদের কাছে যাচ্ছেন দ্রুততম মানবী সুমাইয়াও। বাড়ি যাওয়ার সময় সবার জন্য কিছু না কিছু নিতে মন চায় তাঁর। কিন্তু টাকা পাবেন কোথায়? এখনো যে ছাত্রী তিনি।

তবে ‘ভালো খেলোয়াড়’ হয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চান। বাংলাদেশের জন্য কিছু অর্জন করতে চান সামনে। সেটা করতে পারলে হয়তো অন্য জগৎ থেকে তাঁর বাবাও হয়তো খুশি হবেন।