বিদায় 'ফরএভার ফাস্টেস্ট'

শেষ দৌড়টা আজ দৌড়াবেন বোল্ট। ছবি: এএফপি
শেষ দৌড়টা আজ দৌড়াবেন বোল্ট। ছবি: এএফপি

অ্যাথলেটিকসের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে এবার সবার আগ্রহটা অন্য রকম। কারণটা বলে দিতে হবে না। এটিই যে উসাইন বোল্টের শেষ আসর। সেই বোল্ট, যিনি টানা তিনটি অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছেন। খেলোয়াড়ি জীবনেই যিনি নিজেকে ‘কিংবদন্তি’ ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর বিদায়ী আসরের সাক্ষী হতে তাই সবার এত আগ্রহ। চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর চার দিন আগেই টিকিট বিক্রির রেকর্ড! সেদিন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টিকিট, যা তখনই ছাপিয়ে যায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে টিকিট বিক্রির অতীত সব রেকর্ডকে।

ক্রীড়াঙ্গনে এক কিংবদন্তির প্রস্থানে খুলে যায় আরেকজনের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার দরজা। কিন্তু বোল্টের মতো কজন হয়, একজনও কি হয়, কিংবা আর হবে কখনো? তাঁর মতো কজন পারেন প্রজন্মকে ‘বিদ্যুৎ-ঝলকে’ সম্মোহিত করে রাখতে?
৪০০ মিটার রিলে দৌড়ের কথা তোলা থাক, নেস্তা কার্টার ডোপপাপ না করলে বোল্টের ‘ট্রিপল ট্রিপল’-এর একটা ‘ট্রিপল’ তো ‘ডাবল’ হতো না। কার্টারের সেই পাপে বোল্টের একটি সোনার পদক কাটা পড়লেও এই দুনিয়ায় জ্যামাইকান অদ্বিতীয়। রিও অলিম্পিকেই তো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বোল্ট একদিকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটে নতুন নতুন পালক যোগ করছেন, গণমাধ্যমকর্মীরা অন্যদিকে তাঁর প্রশংসায় বিশেষণের অভাবে ভুগছেন! তুলনা দেবেন, সেটি কাকে দিয়ে? আধুনিক স্প্রিন্টিংয়ের ইতিহাসে বোল্টের সঙ্গে কারই বা তুলনা করা যায়? শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমকর্মীরা তুলে এনেছিলেন ২০০০ বছর আগে রোডসের লিওনিদাসকে। যিনি প্রাচীন অলিম্পিকের টানা চারটি আসরে তিনটি করে দৌড় জিতেছিলেন। কিন্তু ৯.৫৮ সেকেন্ডের ‘বজ্র’ লিওনিদাসের ছিল কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু বোল্ট তো সেই ক্ষিপ্রতার প্রমাণই রেখেছেন।
বেইজিং অলিম্পিকে সেই ‘পাখির বাসা’য় স্প্রিন্টিংয়ের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন বোল্ট। ১০০ মিটার দৌড়ে ফিনিশিংটা হয় সাধারণত কাঁধে কাঁধ লাগানো দূরত্বে। কিন্তু নয় বছর আগের সেই অলিম্পিকে ফিনিশিং লাইন ছোঁয়ার ৩০ মিটার আগেই বুক চাপড়াতে চাপড়াতে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন বোল্ট। এরপর থেকে বোল্ট যতবার ট্র্যাকে নেমেছেন, ততবারই দেখা গেছে সেই দৃশ্য—সবাই বোল্টের থেকে প্রমাণ দূরত্বে পিছিয়ে। কি অলিম্পিক, কি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ—দৃশ্য সব জায়গাতেই এক।
স্প্রিন্টকে অনেকেই বলে থাকেন ‘ডোপিংয়ের আখড়া’! বোল্ট এ ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রমই নন, অন্যদের জন্য উদাহরণও। ডোপিংয়ের জালে ফেঁসে যাওয়া স্প্রিন্ট শুধু বোল্টের পায়ে ভর করে সেই জাল ছিঁড়েফুঁড়ে বেরিয়েছে। ফিরেছে হারানো আবেদনও, সেটাও একা বোল্টের ওপর ভর করেই।
ট্র্যাকে নামার আগেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করার অহংবোধকে বোল্ট যৌক্তিক প্রমাণ করেছেন ট্র্যাকেই। বোল্টের আগে আর কোনো পুরুষ স্প্রিন্টার অলিম্পিকে দুবার স্প্রিন্ট ডাবল জেতেননি। সেখানে বোল্ট জিতেছেন তিনবার। অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে কেউ একবারের বেশি স্প্রিন্ট ডাবল জিততে পারেননি। সেখানে বোল্ট জিতেছেন ছয়বার! সেটিও আবার যেনতেন জেতা নয়, একেবারে বলেকয়ে ট্র্যাকে নেমে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে দৌড় শেষ করে!
অথচ এ মানুষটাই ট্র্যাকের বাইরে ভীষণ আমুদে, শিশুর মতো সরল। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দর্শকদের অংশ করে নেওয়া তাঁর দৌড়ের দর্শন। ওই যে ১০ সেকেন্ডের ভেলকি, যেখানে বোল্ট নামলে শামিল থাকে গোটা বিশ্ব। এটিও তো তাঁর ‘প্যাকেজ’ থেকেই পাওয়া, যেখানে আনন্দ ও উদ্‌যাপনের মাঝে শর্ত একটাই—দৌড়, নিষ্কলঙ্ক দৌড়।
লন্ডনে জীবনের শেষ দৌড়ে পিউমার রানিং শু পরে ট্র্যাকে নামবেন বোল্ট। তাঁর সেই জুতাজোড়ায় লেখা থাকবে—‘ফরএভার ফাস্টেস্ট!’ সত্যি তো! ট্র্যাকের সেই লালগালিচায় আজ বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে তিনটায় ১০০ মিটার স্প্রিন্টে শেষ সংবর্ধনা পাওয়ার আগে যেসব কীর্তি তিনি গড়ে গেলেন, তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তিনি যে ফরএভার ফাস্টেস্ট!