সাঁতারে টারজানের অবিশ্বাস্য কীর্তির ১০০ বছর

টারজান খ্যাত জনি ওয়েসমুলার ছিলেন বিশ্ব সাঁতারের প্রথম মহাতারকাছবি: টুইটার

পোলিও? জলে নেমে পড়ো। কষে সাঁতারও লাগাও। অন্তত লড়তে পারবে!

চিকিৎসক আক্ষরিক এই কথাই বলেছিলেন, তা বলা যায় না। পোলিও আক্রান্ত ছেলেটিকে সাঁতরানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। তাতে পোলিওর সঙ্গে অন্তত লড়াই করা যাবে—পরামর্শটা এমন ছিল। সেই চিকিৎসককে ধন্যবাদ। জনি ওয়েসমুলার জলে না নামলে এই পৃথিবী যেমন অবিশ্বাস্য এক সাঁতারুকে দেখত না, তেমনি ‘টারজান’ সিনেমাতেও সাঁতারের দৃশ্যগুলো জীবন্ত হয়ে উঠত না।

বাংলা প্রবাদে আছে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।’ ওয়েসমুলারের ক্ষেত্রে কথাটা উল্টো বলতে হয়—নামেই পরিচয়! নামটা শুনলেই কারও কারও চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবরি চুলের সুঠাম এক লোক। পরনে গাছের ছাল-পাতা-বাকল দিয়ে বানানো লেংটি। আচরণে বুনো কিন্তু বুদ্ধিমান ও শক্তিতে বলীয়ান। সর্বক্ষণের সঙ্গী এক শিম্পাঞ্জি। একজন প্রেমিকাও আছে। নাম জেন। গাছের ঝুলন্ত রশি ধরে শূন্যে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়ার সময় লোকটা গলা চিরে চিৎকার দেন। ঠিক চিৎকার বলা যায় না, কান্না ও চিৎকারের মিশেলে কিছু একটা। হলিউডে এখনো বলাবলি হয়, কান্নার সুরমিশ্রিত এই চিৎকার ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে সবচেয়ে ‘আইকনিক’ শব্দগুলোর একটি। বাংলাদেশের টিভি পর্দা থেকেও এই শব্দ আছড়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই ধরতে পারছেন। টারজান!

জেনের সঙ্গে টারজান। টারজান চরিত্রে ১২টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন জনি ওয়েসমুলার
ছবি: টুইটার

গত শতকের আশি ও নব্বই দশকে বিটিভিতে টারজান সিরিজ প্রচার করা হতো। কিন্তু যাকে নিয়ে এত কথা, তিনি কিন্তু বিটিভির সেই টারজান নন। সেটি ছিল টিভি সিরিজ, আর ওয়েসমুলার এডগার রাইস বারোজের লেখা অমর সেই অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ নিয়ে বানানো সিনেমার টারজান। রুপালি পর্দায় টারজান চরিত্র তাঁর হাত ধরেই সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। এতটাই যে ১৯৩২ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত টারজান নিয়ে বানানো ১২টি সিনেমায় অভিনয় করেন ওয়েসমুলার। কিন্তু লেখার বিষয় টারজান নিয়ে নয়, ওয়েসমুলারকে নিয়ে। আর সেটাও ১৯২৯ তাঁর প্রথম সিনেমায় নামার আগের ঘটনা।

১৯০৪, ২ জুন। হাঙ্গেরির অধিভুক্ত ফ্রেইডর্ফে জন্ম ওয়েসমুলারের। এই অঞ্চল এখন রোমানিয়ার অধিভুক্ত। সে যা–ই হোক, জন্মের পরের বছর মা–বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান ওয়েসমুলার। ৯ বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে সাঁতরানোর পরামর্শ দেন। ব্যস, সেই যে শুরু হলো! যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা এপি (অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস) ওয়েসমুলারকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সেরা সাঁতারু হিসেবে এমনি এমনি স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯২১ সালে প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার শুরুর পর এক দশকের ক্যারিয়ারে তাঁকে কেউ হারাতে পারেনি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের ভাষায়, সে সময় তাঁর ‘বিশ্বের সর্বকালের সেরা সাঁতারু’ আখ্যা পাওয়াটা অযৌক্তিক ছিল না। মাইকেল ফেলপসের প্রসঙ্গ উঠতে পারে। মার্কিন ‘জলদানব’ ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে এক দশক অপরাজিত থাকলেও এ সময় অন্য ইভেন্টে হেরেছেন। হাঙ্গেরির সাঁতারু তামাস দারমেয়ির নামও বলবেন অনেকে। ২০০ ও ৪০০ মিটার মিডলে ইভেন্টে ৮ বছর অপরাজিত ছিলেন। কিন্তু ওয়েসমুলার ৫০ মিটার থেকে অর্ধমাইল দূরত্বে সাঁতরেছেন। সত্যি বলতে, বিশের দশকের সে সময়টি যুক্তরাষ্ট্রের খেলাধুলার ক্ষেত্রে অন্য রকমই ছিল। তখনকার ক্রীড়া সংবাদকর্মীদের চোখে ‘সোনালি যুগ’—সাঁতারে জনি ওয়েসমুলার, বেসবলে বেব রুথ, টেনিসে বিল টিলডেন এবং মুষ্টিযুদ্ধে জ্যাক ডেম্পসি। সবাই কিংবদন্তি।

১৯২৪ প্যারিস ও ১৯২৮ আমস্টারডাম অলিম্পিক মিলিয়ে সাঁতারে পাঁচটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জেতেন ওয়েসমুলার। যে একটি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন, সেটি ওয়াটার পোলোয়।

ওয়েসমুলার এসব কিংবদন্তির মধ্যেও একটু অন্য রকম ছিলেন। সেটি রুপালি পর্দায় খ্যাতি কুড়ানোর জন্য নয়। গার্ডিয়ানের ভাষায়, ওয়েসমুলার স্রেফ ‘আনন্দ পেতে’ রেকর্ড ভাঙতেন। কি অলিম্পিক ফাইনাল, কি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা নেহাত অনুশীলনের জন্য সাঁতারের পুলে—সামনে যে-ই থাক কোচ, ক্লিনার কিংবা লাইফগার্ড, তাঁদের মজা দিতে কিংবা নিজে মজা পেতে রেকর্ড ভাঙতেন। এই অভ্যাসটা তাঁকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছিল? ওয়েসমুলার অবসর নেওয়ার পর দেখা গেল, সাঁতারে সব মিলিয়ে ৬৭টি বিশ্ব রেকর্ড তাঁর দখলে! জোরালো গুঞ্জন আছে, রেকর্ড ভাঙা ওয়েসমুলারের কাছে এত হেলার বিষয় ছিল যে বেশ কিছু বিশ্ব রেকর্ড গড়েও তিনি স্রেফ হেলাফেলা করেই তা নথিভুক্ত করেননি। যেন, এ আর এমন কী, ছেলের হাতের মোয়া!

কিন্তু বাকিদের কাছে তো বিষয়টি তেমন নয়। সাঁতারের পুল থেকে উঠে আসা সবচেয়ে জনপ্রিয় এই টারজানের এমন কিছু রেকর্ড আছে, যা কেউ কখনো ভাঙতে পারবে না। আসলে কেউ কোনো কীর্তি প্রথমবারের মতো গড়লে তা তো আর ভাঙা সম্ভব নয়। এমনই এক ‘প্রথম’ হলো—১৯২২ সালের ১৯ জুন বিশ্বের প্রথম সাঁতারু হিসেবে ১০০ মিটার সাঁতার এক মিনিটের মধ্যে শেষ করেন ওয়েসমুলার। ৫৮.৬ সেকেন্ডে শেষ করা সেই সাঁতারটি ছিল ফ্রিস্টাইল ইভেন্ট। ক্যালিফোর্নিয়ার আলমেদায় ওয়েসমুলার এই রেকর্ড গড়েছিলেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। আজ সেই কীর্তির ১০০ বছর পূর্তি।

ওয়েসমুলারের কীর্তি আছে আরও। পরের বছর পৃথিবীর প্রথম সাঁতারু হিসেবে ৪৪০ গজ এবং ৪০০ মিটার সাঁতার ৫ মিনিটের মধ্যে শেষ করার বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। ৪ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের সেই রেকর্ড গড়েছিলেন আগের বছর নিজেরই গড়া রেকর্ড ভেঙে। আসলে ওয়েসমুলার শুরুতেই পড়েছিলেন সাঁতারের পাকা জহুরির হাতে—তখন ইলিনয় অ্যাথলেটিক ক্লাবের কোচ ‘আদুরে অত্যাচারী’ নামে খ্যাত বিল বাখরাখ। বব স্কেলটন, মাইক ম্যাকডরম্যাট, আর্নি বোর্গ ও সিবিল বাউয়ারের মতো সোনালি সব সাঁতারু তাঁর হাত ধরেই উঠে এসেছেন। বাখরাখ ওয়েসমুলারের প্রতিভা টের পাওয়ার পর তাঁকে শুরুতেই পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে দেননি। একদম তৈরি করে তারপর ছেড়েছেন। শিকাগো ট্রিবিউন লিখেছিল, ‘১৯২১ সালের আগস্টে ৫০ গজ ও ২২০ গজ সাঁতারে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি কখনো হারেননি।’

১৯২৯ সালে জনি ওয়েসমুলার
ছবি: টুইটার

১৯২৪ প্যারিস ও ১৯২৮ আমস্টারডাম অলিম্পিক মিলিয়ে সাঁতারে পাঁচটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জেতেন ওয়েসমুলার। যে একটি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন, সেটি ওয়াটার পোলোয়। হ্যাঁ, ওয়াটার পোলো এবং উচ্চ লম্ফেও ভালো দখল ছিল তাঁর। ১৯২৪ প্যারিস অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াটার পোলো দলের হয়ে ব্রোঞ্জ জেতেন। সব মিলিয়ে অলিম্পিকে পাঁচটি স্বর্ণ, একটি ব্রোঞ্জ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৫২ বার শিরোপা জিতেছেন ওয়েসমুলার। মজার বিষয়, তাঁর অলিম্পিক পদক চুরিও গিয়েছিল। ১৯৮৪ সালে ওয়েসমুলারের মৃত্যুর ২১ বছর পর তা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয় আন্তর্জাতিক সুইমিং হল অব ফেম মিউজিয়াম।

দেখতে সুন্দর ও সুঠাম হওয়ায় সাঁতার ছাড়ার পর তিরিশের দশকের শুরুতে মডেলিংয়ে নেমেছিলেন ওয়েসমুলার। অন্তর্বাস ও সুইমস্যুট বানানো প্রতিষ্ঠানেরও প্রতিনিধি ছিলেন। চলে এসেছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেসে—মানে হলিউডে। তখন টারজান সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনেতা খুঁজছিল বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা এমজিএম। অনেকেই তাঁকে অডিশন দেওয়ার কথা বললেও ওয়েসমুলার শুরুতে আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু যখন বলা হলো, এমজিএমে গেলে গ্রেটা গার্বো (গন উইথ দ্য উইন্ড, মাতা হারি) ও ‘কিং অব হলিউড’খ্যাত ক্লার্ক গেবলের (ইট হ্যাপেনড ওয়ান নাইট) সঙ্গে দেখা করা এবং একসঙ্গে বসে খাওয়ার সুযোগ পাবেন—ওয়েসমুলার এরপর আর না বলেন কীভাবে!

বাকিটা ইতিহাস।