গানের তালে নাচলেন হকির ছেলেমেয়েরা, পুরস্কার বেড়ে হলো ৫০ হাজার টাকা
‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’—একে একে বেজে চলছে জনপ্রিয় সব গান। আর গানের তালে তালে নাচছেন একদল তরুণ-তরুণী। তাঁরা চেনা কেউ নন, ক্রীড়াঙ্গনে উঠতি মুখ। সবাই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলের খেলোয়াড়। দেশের হকির নিত্য অভাব আর বিরোধের সংসারে একঝাঁক নবীনের সৌজন্যে নাচ-গানে ভরপুর একটা দিনই কেটেছে। এমন দিন হকিতে কে কবে দেখেছে!
আজ দেখেছে। রাজধানীতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি কুর্মিটোলায় ছায়া সুশীতল শাহীন দ্বীপে। দ্বীপ মানে, আক্ষরিক অর্থে দ্বীপ নয়। তবে একপাশ লেকে ঘেরা। লেকের পাড়ে সারি সারি নারকেল আর অন্যান্য গাছ। বিনোদনের জন্য দারুণ জায়গা। এ বছর ডিসেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় যুব বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দিতে মনোরম এ জায়গাটিই বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন।
গত মাসের শুরুতে ওমানে এশিয়ান অনূর্ধ্ব-২১ হকিতে পঞ্চম হয়ে বাংলাদেশ পুরুষ হকি দল বিশ্বকাপে উঠে ইতিহাস গড়ে। হকির কোনো বিশ্বকাপে এটিই বাংলাদেশের প্রথম জায়গা করে নেওয়ার ঘটনা। একই টুর্নামেন্টে নারী বিভাগে বাংলাদেশের মেয়েরা নবম হওয়ায় বিশ্বকাপে উঠতে পারেনি। তবে ছেলেদের সঙ্গে আজ মেয়েরাও পেয়েছেন সংবর্ধনা। বাড়তি পাওনা হয়ে থাকল পুরো একটি আনন্দময় দিন। আর তা কাজে লাগিয়ে যুব হকি দলের ছেলেমেয়েদের গানের তালে তালে সে কী উচ্ছ্বাস, নাচ!
৫ ডিসেম্বর ওমান থেকে ফেরার দিনই বিমানবন্দর থেকে ছেলেদের সরাসরি নেওয়া হয় বিমানবাহিনীর ফ্যালকন হলে। সেদিন হকি ফেডারেশনের পক্ষে বাংলাদেশ যুব হকি দলকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৮ খেলোয়াড় ও কোচ, ফিজিও, ম্যানেজার মিলে ২১ জনের জন্য জনপ্রতি বরাদ্দ পড়ে মাত্র ২৪ হাজার টাকা। যা তরুণদের সাফল্যের তুলনায় অনেক কম বলছিলেন অনেকেই।
সেটা বুঝতে পেরে হকি ফেডারেশন খেলোয়াড়দের হাতে আজ তুলে দিয়েছে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকার চেক। ২১ জন পেয়েছেন ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর আগে ক্রীড়া উপদেষ্টার দেওয়া ২০ লাখ টাকায় প্রতিজনের ভাগে পড়েছে ৯৫ হাজার ২৩৮ টাকা। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে ওঠার আর্থিক প্রাপ্তি খেলোয়াড়প্রতি ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৩৮ টাকা। মেয়েরা আর্থিক পুরস্কার পাননি। তাঁরা পেয়েছেন শুধু ক্রেস্ট।
কিন্তু ক্রেস্ট, সংবর্ধনা আর কিছু আর্থিক পুরস্কারই সব নয়। দরকার বিশ্বকাপের জন্য ভালো প্রস্তুতি। প্রস্তুতির জন্য চাই টাকা। সেটা ভেবেই এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল দেশের দুই বড় ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে। বাফুফের সভাপতি দেশে নেই। তবে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ এসেছেন অনুষ্ঠানে। যদিও হকির জন্য সরাসরি কোনো ঘোষণা দেননি তিনি।
ফারুক অবশ্য হকির এ দলটির পাশে থাকার কথা বলেছেন, ‘যেসব খেলায় সম্ভাবনা আছে, যতটুকু পারি বিসিবির পক্ষ থেকে সেখানে আমরা সহযোগিতা করব।’
হকি খুবই সম্ভাবনাময় খেলা উল্লেখ করে যুবাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন ফারুক। তাঁদের অর্জনকে অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমরা কে কোন খেলার, সেটা ব্যাপার নয়। আমাদের ঠিক করতে হবে, আগে দেশ। অনেক সময় ব্যক্তিগত এজেন্ডায় চলে যাই আমরা। এ জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যেতে পারি না। সবাই মিলে প্রতিটি ডিসিপ্লিন এগিয়ে নিতে পারি।’ আশির দশকের শুরুতে নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আমি যখন খেলেছি, বিদেশে পাঁচ ডলার হাতখরচ পেয়েছি প্রতিদিন। এখন কত পায় বলতে চাই না।’
যুবাদের পাশে থাকতে স্পনসরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সভাপতি ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। বিশ্বকাপে ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য নিজের ক্ষমতাবলে যতটা সম্ভব করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। যুবাদের এই অর্জন দেশের হকিতে নতুন দিনের সূচনা করেছে। তবে সামনে একটা চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা হলো আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে খেলোয়াড়দের বিশ্বমঞ্চের জন্য প্রস্তুত করা। এ কথাগুলো উল্লেখ করে বিমানবাহিনীর প্রধান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষণ ও খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক ম্যাচ, বিশেষ করে ইউরোপের দলগুলোর সঙ্গে খেলার চেষ্টা করব।’
কোচ, খেলোয়াড়, কর্মকর্তারা, সবাই জোর দিয়েছেন বিশ্বকাপের জন্য ভালো প্রস্তুতির ওপর। এখনই প্রস্তুতি শুরু করা উচিত বলে মনে করেন ওমানে বাংলাদশ দলের ম্যানেজার হয়ে যাওয়া বিকেএসপির সাবেক প্রধান হকি কোচ কাওসার আলী, ‘ক্যাম্প শুরু করতে আর এক দিনও দেরি করা ঠিক হবে না।’
সফল কোচ মওদুদুর রহমান শুভ যোগ করেন, ‘আজকের অনুষ্ঠান বিশ্বকাপের জন্য ছেলেদের উজ্জীবিত করবে।’
অধিনায়ক মেহরাব হাসানের কথায়ও সেটার প্রতিধ্বনি, ‘দারুণ অনুষ্ঠান হয়েছে। হকিতে আগে কখনো এমন হয়নি। আমরা খুব উৎসাহ পেলাম।’ ক্যাম্প দ্রুত শুরুর দাবি তাঁরও, ‘এখনই ক্যাম্প শুরু করলে নিজেদের ভালোভাবে তৈরি করতে পারব। ইউরোপের টিমের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দেবেন, বলেছেন চিফ স্যার। আশা করি, সেই সুযোগ পাব।’
অনূর্ধ্ব-২১ নারী দলের অনেকে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। তাদের অভিজ্ঞতা বাড়াতে অধিনায়ক অর্পিতা পালের চাওয়া আন্তর্জাতিক ম্যাচ। অনুষ্ঠানে এসে তিনি আপ্লুত, ‘এমন অনুষ্ঠান হবে, ধারণা ছিল না। আমরা এশিয়া কাপে ভালো করিনি। তারপরও এত সুন্দর সংবর্ধনায় খুব খুশি সবাই।’
বিকেএসপি থেকে অর্পিতারা সকাল ১০টায় এসেছেন শাহীন দ্বীপে। ফিরলেন বিকেল পাঁটচার দিকে। কয়েক ঘণ্টার আনন্দময় স্মৃতি নিয়ে গেলেন সঙ্গে।