ইতিহাস গড়ে দাবা অলিম্পিয়াডে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া ও তাঁর ছেলে তাহসিন

বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলবেন বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ও ছেলে ফিদে মাস্টার তাহসিনছবি: প্রথম আলো

স্বপ্নটা এত তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে যাবে, তা মোটেও ভাবেননি তাহসিন তাজওয়ার জিয়া। ২০১৪ সালে নরওয়ের ট্রমসোতে ৪১তম দাবা অলিম্পিয়াডে বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে গিয়েছিলেন তাহসিন।

পাশে দাঁড়িয়ে বাবার খেলা গভীর মনোযোগে দেখতেন। ওই সময়ই ভাবতেন, ‘যদি বাবার মতো আমিও অলিম্পিয়াডে খেলতে পারতাম!’ সেই ভাবনা অবশেষে সত্যি হতে যাচ্ছে তাঁর।

২৯ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট ভারতের চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত হবে ৪৪তম দাবা অলিম্পিয়াড। ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলবেন বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ও ছেলে ফিদে মাস্টার তাহসিন।

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

এই দলের অন্য দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, এনামুল হোসেন রাজীব ও ফিদে মাস্টার মেহেদী হাসান পরাগ। মেয়েদের দলে খেলবেন জান্নাতুল ফেরদৌস, শারমিন সুলতানা, নাজরানা খান, নোশিন আঞ্জুম, প্রতিভা তালুকদার। দাবা অলিম্পিয়াডে খেলতে আগামীকাল ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন বাংলাদেশের দাবাড়ুরা।

১৯৮৪ সাল থেকে দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ দাবা দল। কিন্তু বাংলাদেশের দাবা ইতিহাসে কখনোই অলিম্পিয়াডে একসঙ্গে খেলেননি বাবা ও ছেলে।

বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক আরবিটার হারুনুর রশীদ ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ম্যাচ পরিচালনা করেন। তিনিও বাবা-ছেলের দাবা অলিম্পিয়াডে খেলার এমন ঘটনাকে বিরল বললেন, ‘আমি অনেক দিন ধরে আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করছি।

পদক হাতে বাবা ও ছেলে
ফাইল ছবি

কিন্তু কখনো আমার চোখে পড়েনি একই সঙ্গে বাবা ও ছেলে পাশাপাশি বোর্ডে খেলছেন। যদিও উজবেকিস্তানে বাবা ও ছেলে গ্র্যান্ডমাস্টার আছেন (তাহির ভাখিদভ ও জাহাঙ্গীর ভাখিদভ)। কিন্তু তাঁরাও কখনো একসঙ্গে অলিম্পিয়াডে খেলেননি।’

সাধারণত জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা পাঁচজন দাবাড়ু নিয়ে গড়া হয় অলিম্পিয়াডের দল। জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া দাবাড়ুদের মধ্যে পঞ্চম হয়ে অলিম্পিয়াডের দলে জায়গা করে নিয়েছেন তাহসিন।

তাহসিন তাজওয়ার জিয়ার জন্য এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মিলনায়তনে দাবা অলিম্পিয়াড উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ফেডারেশন। প্রথমবার সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিলেন বাবা ও ছেল। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন শেষে সব আলো কেড়ে নিলেন তাহসিন।

এর আগে বিভিন্ন ঘরোয়া টুর্নামেন্টে ও প্রিমিয়ার লিগে একাধিকবার বাবা ও ছেলে দাবার বোর্ডে মুখোমুখি হয়েছেন। প্রিমিয়ার লিগে বাংলাদেশ বিমানের হয়ে খেলেছেন তাহসিন, বাংলাদেশ পুলিশের জার্সিতে খেলেন জিয়া।

কখনো বাবার সঙ্গে ড্র করেছেন। কখনো হারিয়ে দিয়েছেন বাবাকে। কিন্তু একই দলে একবারই বাবা ও ছেলে খেলেছিলেন সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে। বাংলাদেশ আনসারের হয়ে সেবার সোনা জেতেন তাঁরা।

দাবা অলিম্পিয়াডে ছেলেকে নিয়ে খেলবেন, সেই স্বপ্নটা জিয়া দেখতেন অনেক আগে থেকেই। ভারত যাত্রার আগে রোমাঞ্চিত জিয়া বলছিলেন, ‘ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দাবা অলিম্পিয়াডে খেলব, এটা আমার স্বপ্ন ছিল। ও যখন থেকে খেলা শুরু করে, তখন থেকে ভাবতাম কবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। আমার দুজন দেশের জার্সিতে খেলব, এটা খুব গর্বের ব্যাপার।’

তাহসিনের বর্তমান ফিদে রেটিং ২৩০৭। এবারের অলিম্পিয়াডে তাহসিনকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখছেন জিয়া, ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ও প্রিমিয়ার লিগে সে ভালো খেলেছে। সম্প্রতি র‌্যাপিড টুর্নামেন্টে ওর কাছে হেরেছি আমি। ও যদি ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে ভারতে, তাহলে ওর রেটিং বাড়বে। আমার ছেলে এখন তরুণ। অনেক বেশি অনুশীলন করতে পারে। আমি যে রেকর্ড করিনি, সেটা যেন ও করতে পারে, সেটাই চাইব।’

বাবার কাছেই দাবার হাতেখড়ি ১৬ বছর বয়সী তাহসিনের। সেন্ট যোসেফ স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র বাবাকেই দাবায় আদর্শ মানেন। অলিম্পিয়াডে বাবার সঙ্গে খেলতে পারা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার তাহসিনের, ‘বাবা আমার চেয়ে সব দিক দিয়ে এগিয়ে। উনি গ্র্যান্ডমাস্টার। সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।

বাবার সঙ্গে অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে খেলব, এটা অনেকটা স্বপ্নের মতো লাগছে আমার কাছে। আমি সেখানে সেরাটা দিতে চাই। প্রথম অলিম্পিয়াড স্মরণীয় করে রাখতে চাই।’

প্রিমিয়ার লিগ দাবায় মুখোমুখি হয়েছিলেন বাবা-ছেলে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানাও দাবাড়ু। এমনিতে জিয়ার সঙ্গে দেশ–বিদেশে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেন। এবার এই দাবা পরিবার উপভোগ করতে চান অলিম্পিয়াডের প্রতিটি গেম।

ছেলে অলিম্পিয়াডে খেলবে, ঘোরলাগা বিস্ময় তাসমিনের কণ্ঠে, ‘আমার স্বপ্ন ছিল বাবা ও ছেলে একদিন দেশের হয়ে খেলবে। কিন্তু এটা আশা করিনি যে তাহসিন এবারই সুযোগ পাবে। ওকে যদি খেলার সুযোগ দেয় সব বোর্ডে আর কমপক্ষে সাড়ে ছয় পয়েন্ট পায়, তাহলে রেটিংটা অনেক বেড়ে যাবে।’