পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষকে চেনেন তো

প্রথম আলো গ্রাফিকস

স্যামুয়েল গোল্ডউইন হলিউডের কিংবদন্তি সিনেমা প্রযোজক। বেসবলে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। খেলাটা কীভাবে খেলে সেটাও জানতেন না। হলিউডেও তখন প্রচলিত একটা ধারা হলো, খেলাধুলা নিয়ে বানানো সিনেমা বক্স অফিসের জন্য ভালো না। কারণ? সিনেমার বেশির ভাগ দর্শক নারী। সিনেমায় যাওয়া হবে কি না, বেশির ভাগ পরিবারে এই সিদ্ধান্ত নেনও নারীরা। খেলাধুলার সিনেমায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই। অতএব লোকসান হবেই।

লু গেরিগের জীবন নিয়ে সিনেমা বানানোর প্রস্তাব তাই শুরুতে বাতিল করে দিয়েছিলেন স্যামুয়েল। গেরিগ সম্পর্কে তিনি নিজেও তেমন কিছু জানতেন না। ১৯৪১ সালের একদিন স্যামুয়েলের চিত্রনাট্য সম্পাদক নিভেন বুশ গেলেন তাঁর কাছে। বায়না ধরলেন স্ক্রিনিং রুমে ছোট্ট একটা নিউজরিল দেখতে হবে। স্যামুয়েল গেলেন। নিউজরিলটি প্যারামাউন্টের, ইয়াঙ্কি স্টেডিয়ামে গেরিগের বিদায়ী ভাষণ ধারণ করা হয়েছে, সেটা ১৯৩৯ সালের ৪ জুলাইয়ের ঘটনা।

সেদিন গেরিগের সেই কথাগুলো পরবর্তী সময়ে বেসবলে ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ (গেটিসবার্গ ভাষণ) হিসেবে মর্যাদা পায়।

কারণটা, বুঝে নিতে পারেন স্যামুয়েলের অভিজ্ঞতা থেকে।

গেরিগ চরিত্রে অভিনয় করা গ্যারি কুপারের সঙ্গে বেসবল কিংবদন্তি বেব রুথ। সিনেমায় তিনি গেরিগের সতীর্থের ভূমিকায়
আইএমডিবি

উপচে পড়া ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের সামনে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে গেরিগের বিদায়ী কথাগুলো শুনে স্যামুয়েল কেঁদে ফেলেন। এই মুহূর্তের সুযোগটা নিতে ভুল করেননি নিভেন। গেরিগের জীবন নিয়ে স্যামুয়েলকে সিনেমা বানাতে বললেন। স্যামুয়েল রাজি তো হলেনই, বানানোর আগেই বলে দিলেন, এমন সিনেমা তাঁর কাছে আসলে ‘বেসবল নয়, মানুষের জীবনচিত্র।’

সেই মানুষের জীবনের পরিচয়টা দিতে হয়।

হেনরি লুইস গেরিগ। যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ বেসবলে ১৭ মৌসুম খেলা কিংবদন্তি। এক অত্যাশ্চর্য হিটার এবং সহনশীল ও সরল মানুষ। টানা সাতবারের অলস্টার সেভেন, ট্রিপল ক্রাউনজয়ী, ছয়বার ওয়ার্ল্ড সিরিজজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, ১৯৬৯ সালে আমেরিকা বেসবল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে সর্বকালের সেরা ফার্স্ট বেসম্যানের স্বীকৃতি পাওয়া। আরেকটু বলতে হয়। একসময় সর্বোচ্চ ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্লামের (২৩) রেকর্ডও গেরিগের ছিল। পাশাপাশি তাঁর টানা সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড (২১৩০) টিকে ছিল ৫৬ বছর (১৯৯৫ সালে রিপকেন জুনিয়র ভাঙেন)।

গেরিগের খুদে ভক্ত
আইএমডিবি

টানা খেলতে খেলতে গেরিগ থেমেছিলেন ১৯৩৯ সালের ২ মে। সেদিনের ম্যাচ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। চমকে গেলেন সবাই। কোনো এক অজানা কারণে তাঁর ফর্ম নেমে গিয়েছিল সত্য, শটে জোর পেতেন না। তাই বলে খেলবেন না! পরে জানা গেল, ‘অ্যামায়াট্রফিক ল্যাটারাল স্কেলেরোসিস’ রোগে ভুগছেন গেরিগ। সময় আর বেশি নেই।
নিউইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের ‘আয়রন হর্স’ গেরিগ মারা গেলেন ১৯৪১ সালের ২ জুন।

ইয়াঙ্কিসরা গেরিগের ৪ নম্বর জার্সি তুলে রাখল চিরতরে। এমএলবির ইতিহাসে সেটাই প্রথম কোনো খেলোয়াড়ের জার্সি তুলে রাখার ঘটনা। আর গেরিগের প্রস্থানে নতুন নাম পেল ওই রোগটা, ‘লু গেরিগ ডিজিজ।’

সিনেমায় গেরিগের মাঠের গল্পটা শুধু বলা হয়নি। গেরিগের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণভাবে উপস্থিত। সেই শারীরিকভাবে চলতে অক্ষম সেই খুদে ভক্ত, যাকে গেরিগ কথা দিয়েছিল এক ম্যাচে দুটি হোমরান নেবে, আছে সেই গল্পও।

আরও পড়ুন

তবে গেরিগের ব্যক্তিগত জীবনের চিত্রায়ণে কিংবদন্তি অভিনেত্রী টেরেসা রাইটের ভূমিকা বেশ বড়। ১৯৪১ সালে স্যামুয়েলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যান পরের বছর ‘মিস মিনিভার’–এ অস্কারজয়ী টেরেসা। স্যামুয়েল তাঁকে গেরিগের প্রেমিকা এবং পরবর্তী সময়ে স্ত্রী এলেনরের চরিত্রটি দেন। বেসবল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলেও প্রযোজক ও অভিনেত্রী এই খেলার প্রায় কিছুই জানতেন না। টেরেসাকে সাহায্য করেছিলেন গেরিগের স্ত্রী। সিনেমায় টেরেসার হাতে যে ব্রেসলেট দেখা যায় সেটা আসল এলেনরকে দেওয়া গেরিগের উপহার। শেষ দৃশ্যে স্টেডিয়ামের টানেলে টেরেসার দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি আবেগময়।

পরিচালক স্যাম উড বেসবলের ভক্ত ছিলেন। গেরিগের গল্পকে বেসবলকে ছাপিয়ে মানুষের জীবনচিত্র বানিয়ে তুলতে এক শতে এক শ পেতে পারেন। হলিউডের চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের গল্প বলার ক্ল্যাসিক স্টাইল, যেখানে খুব সরল এক পরিবার, মা-ই সর্বেসর্বা, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখেন, ওদিকে ছেলেকে দেখে বাকিরা বুঝেছে, ওর জন্মই হয়েছে বেসবল খেলার জন্য। উডের ক্যামেরায় মাঠের গেরিগ থেকে আসলে মাঠের বাইরের গেরিগের প্রাধান্যই বেশি। তাতে বেসবল না বোঝা দর্শকের কাছেও সিনেমাটা হয়ে উঠেছে উপভোগ্য।

গেরিগের প্রেমিকা ও স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন টেরেসা রাইট
আইএমডিবি

সিনেমাটির প্রচার ও প্রসারের (ডিস্ট্রিবিউশন) দায়িত্বে থাকা আরকেও পিকচার্স গেরিগের চরিত্রে অভিনেতা খুঁজতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ওদিকে স্যামুয়েল ও উড ঠিক করে রেখেছিলেন গেরিগের চরিত্রে গ্যারি কুপার একদম মানানসই। গেরিগের মতোই একহারা শরীর। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় কুপারের ৪১ বছর বয়স। কুশলী আলোকচিত্রী রুডলফ মেট গেরিগের অল্প বয়সের চিত্রায়ণে নিচ থেকে আলো ধরেন যেন মুখের বলিরেখাগুলো টের না পাওয়া যায়। পর্দায় গেরিগের বয়স যত বেড়েছে রুডলফের ঝামেলাও কমেছে।

আরও পড়ুন

তবে কুপারকে ঝামেলা পোহাতে হয়। বেসবলের ব্যাটটা জীবনে কখনো ঘুরিয়ে দেখেননি। গেরিগ ছিলেন বাঁহাতি, কুপার ডানহাতি। ১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই সিনেমাটি নিউইয়র্কে মুক্তি পাওয়ার পর বেশ কিছু প্রকাশনা দাবি করে, কুপার বাঁ হাতে ব্যাট চালানো আয়ত্ত করতে পারেননি। ডান হাতেই চালিয়েছেন, জার্সিটা উল্টো করে পরে, সিনেমার প্রিন্ট উল্টো করা হয়েছে। পরে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বেসবল হল অব ফেমের সিনিয়র কিউরেটর টম শিবের দেখান কুপার বাঁ হাতেই ব্যাট চালিয়েছেন। একবারই ফুটেজ উল্টো করা হয়েছে, সেটা কুপার যখন পিচার।

সিনেমার শেষ দৃশ্যে স্টেডিয়ামে গেরিগ চরিত্রে কুপারের বলা, ‘টুডে আই কনসিডার মাইসেল্ফ ইন দ্য ফেস অব দ্য আর্থ’ সংলাপটি আমেরিকার ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জরিপে সিনেমার ১০০ সেরা সংলাপের মধ্যে ৩৮তম। সেদিন গেরিগও এই কথাটি বলেছিলেন। আর পাশে ছিলেন বেব রুথ। বেসবলের আরেক কিংবদন্তি এবং গেরিগের সতীর্থ। এই সিনেমার বেশ বড় একটা অংশজুড়ে আছে তাঁর উপস্থিতি। ওজন কমিয়ে এই সিনেমায় অভিনয় করার পথে নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেলেছিলেন বেব রুথ।

বাঁ হাতে ব্যাট করা আয়ত্ত করতে হয় গ্যারি কুপারকে
আইএমডিবি

অস্কারে ১১টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেলেও একটি জিতেছিল ‘দ্য প্রাইড অব দ্য ইয়াঙ্কিস’। খেলাধুলা নিয়ে বানানো সর্বকালের অন্যতম সেরা এই সিনেমাটি মুক্তির প্রায় এক বছর আগে মারা যান গেরিগ। তখন তাঁর বয়স ৩৭ বছর।

‘দ্য প্রাইড অব দ্য ইয়াঙ্কিস’ (১৯৪২):  

পরিচালক: স্যাম উড

প্রযোজক: স্যামুয়েল গোল্ডউইন, উইলিয়াম ক্যামেরন।

অভিনয়ে: গ্যারি কুপার, টেরেসা রাইট, বেব রুথ, ওয়াল্টার ব্রেনান।

আইএমডিবি রেটিং: ৭.৬/১০

রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট।

আরও পড়ুন