উসাইন বোল্টের কিংবদন্তি হওয়ার দিন

২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ২০০ মিটারে সোনা জয়ের পর উসাইন বোল্টছবি: এএফপি

কিংবদন্তি হওয়ার কি নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ থাকে? এটা আবার কেমন প্রশ্ন! সারা জীবনের অর্জন মিলিয়েই না কেউ কিংবদন্তি হয়ে যান। উসাইন বোল্ট সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম। সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টার—এ নিয়ে কোনো তর্ক নেই। কিংবদন্তি, এটাও তো সংশয়াতীত। তারপরও কেন বলা, ২০১২ সালের ৯ আগস্ট অর্থাৎ ১১ বছর আগে এই দিনেই জ্যামাইকান স্প্রিন্টার কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিলেন!

কারণ উসাইন বোল্ট নিজেই। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ১০০ মিটার জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে বোল্টই তাঁর কিংবদন্তি হওয়ার দিনক্ষণ জানিয়ে দিয়েছিলেন। চার দিন পরের ২০০ মিটার স্প্রিন্টের কথা তুলে নিজেই বলেছিলেন, ‘ওটা জিতলেই আমি কিংবদন্তি হয়ে যাব।’

আরও পড়ুন

চার বছর আগে বেইজিংয়ে সগৌরব আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে কার্ল লুইসের পর প্রথম স্প্রিন্টার হিসেবে ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ জিতেছেন। পরে জিতেছেন ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেও। তিনটিই বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। এতেও আসলে বোল্ট–মহিমার পুরোটা বোঝানো যায় না।

১০০ মিটার জয়ের আগেই উদ্‌যাপন শুরু করে দিয়েছিলেন। বাকিরা যে তখন অনেক পেছনে। বুক চাপড়ে আগেই উদযাপন শুরু করে না দিলে টাইমিং ৯.৬৯ সেকেন্ডের চেয়ে আরও কম হতো। কমে কত হতে পারত? সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছিল পরের বছরই, যখন বার্লিনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের বিশ্ব রেকর্ডকে ৯.৫৮ সেকেন্ডে নামিয়ে আনেন বোল্ট। ১৪ বছর হতে চলল, সেই রেকর্ড এখনো ভাঙতে পারেনি কেউ।

২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে বাকিদের অনেক পেছনে ফেলে উসাইন বোল্ট
ছবি: এএফপি

বোল্টকে নিয়ে এভাবে লিখতে গেলে তা আর শেষ হবে না। অলিম্পিকে তাঁর সব কীর্তিরই প্রত্যক্ষদর্শী। প্রত্যক্ষদর্শী মানে সাংবাদিক হিসেবে প্রেসবক্স থেকে তা দেখেছি। দৌড়ের পর মিক্সড জোনে কথা বলেছি, পরে সংবাদ সম্মেলনেও। বলার চেয়ে অবশ্য শুনেছিই বেশি। বোল্টকে নিয়ে এত স্মৃতি যে, একটা এসে আরেকটাকে ছাপিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমরা বরং ১৩ বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকের ওই দিনটিতেই থাকি। সেই দিনে, যেদিন উসাইন বোল্ট তাঁর সংজ্ঞা অনুযায়ী কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তা করার আনন্দে যা করেছিলেন, লিখতে লিখতে সেই ছবিটা ভেসে উঠছে চোখে। সেটিও বেইজিংয়ে ১০০ মিটারের সেই উদ্‌যাপনের মতোই স্মরণীয়। সেই উদ্‌যাপনও জয়ের পর নয়, সমাপ্তিরেখাটাই তো পেরোলেন ঠোঁটে আঙুল রেখে।

২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ২০০ মিটার জয়ের পথে ঠোঁটে আঙুল রেখে সমালোচকদের প্রতি বোল্টের বার্তা
ছবি: রয়টার্স

জ্যামাইকান ট্রায়ালে ১০০ ও ২০০ মিটার দুটিতেই পরাজয় আর চোট-টোট মিলিয়ে যাঁরা উসাইন বোল্টের শেষ দেখে ফেলেছিলেন, আবারও ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ জিতে ইতিহাস গড়াই তাঁদের জন্য যথেষ্ট জবাব ছিল। সেটিতেই সন্তুষ্ট থাকলে তিনি আর বোল্ট কেন!
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে কী বুঝিয়েছেন, সংবাদ সম্মেলনে এসে সেটিও বলেছিলেন তীব্র শ্লেষের সঙ্গে, ‘অনেক আজেবাজে কথা হয়েছে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওদের বললাম, “স্টপ টকিং”। আমি এখন জীবিত কিংবদন্তি।’

বিশ্ব রেকর্ড ১৯.১৯ সেকেন্ড। আর এদিন বোল্টের টাইমিং ১৯.৩২ সেকেন্ড। চাইলে হয়তো রেকর্ডটা ভেঙেও ফেলতে পারতেন। ১৫ মিটার বাকি থাকতেই তো পাশে তাকাতে শুরু করলেন। শেষ পদক্ষেপটা যত বেশি সম্ভব লম্বা করতে স্প্রিন্টাররা সামনে ঝুঁকে শেষ করেন, আর বোল্ট ঠোঁটে আঙুল রেখে টানটান বুকে সোজা মাথায় পেরোলেন সমাপ্তিরেখা। কেন, রেকর্ড ভাঙার চেষ্টা করলেন না কেন? কারণ ছিল। ‘বাঁকটাতে খুব দ্রুত দৌড়াতে চেয়েছিলাম। তা করতে গিয়ে পাশে একটু টানমতো লেগেছিল। এরপর শুধু ব্লেকের দিকে চোখ রেখেছি, ও যেন সামনে চলে না যায়।’

অনেক আজেবাজে কথা হয়েছে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওদের বললাম, “স্টপ টকিং”। আমি এখন জীবিত কিংবদন্তি।
উসাইন বোল্ট, কিংবদন্তি স্প্রিন্টার

বোল্টকে নিয়ে সংশয়ের বীজটা বুনে দিয়েছিলেন এই ইয়োহান ব্লেকই, জ্যামাইকান ট্রায়ালে বোল্টকে দুবার হারিয়ে। শুনে অবাক হবেন, এ জন্য ব্লেকের কাছে বোল্টের কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। ১০০ মিটার জয়ের পর যা বলেছিলেন, এদিন আবার বললেন তা, ‘ও আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। এটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট।’

জেতার পর বোল্ট কী কী করলেন, তা নিয়েই মজার একটা টিভি অনুষ্ঠান হতে পারে। সংশয়বাদীদের মুখ বন্ধ করে রাখার বার্তাটা যথেষ্ট দেওয়া হয়েছে মনে হওয়ার পর ট্র্যাকে কয়েকবার বুকডন দিয়ে নিলেন। ল্যাপ অব অনার দিতে দিতে এক আলোকচিত্রীর কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে উল্টো আলোকচিত্রীদেরই ছবি তুলতে শুরু করলেন। ছবি তুললেন ইয়োহান ব্লেকেরও। হঠাৎ ছুটে গিয়ে উবু হয়ে চুমু খেলেন সমাপ্তিরেখায়। উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সেই ট্রেডমার্ক উদ্‌যাপন—কাল্পনিক ধনুকে কাল্পনিক তির ছোড়া।

২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ২০০ মিটারে সোনা জয়ের পথে বোল্ট
ছবি: এএফপি

বেইজিং থেকেই এটি করে আসছেন। তবে এদিন মনে হলো, এই তিরটাও বুঝি সমালোচকদের বুকেই বিদ্ধ করতে চেয়েছেন। সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টার হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। ক্রীড়া ইতিহাসে বোল্টের স্থান নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে গেছে তখন। বোল্ট কি এখন মোহাম্মদ আলী-পেলে-মাইকেল জর্ডানদের মতো নির্দিষ্ট কোনো খেলার সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া সর্বজনীন ক্রীড়া কিংবদন্তি?

মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল আছে। সেটি কি কখনো কখনো ঔদ্ধত্য মনে হওয়া প্রবল আত্মবিশ্বাসে! আলী একবার অবলীলায় বলেছিলেন, ‘আমার মতো গ্রেট হলে বিনয়ী হওয়া কঠিন।’ সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে বোল্ট নিজেকে এতবার ‘সেরা’ আর ‘কিংবদন্তি’ বললেন যে মোহাম্মদ আলীকে বারবারই মনে পড়ল।
তবে বোল্টও বিনয়ী হতে জানেন! আলী-জর্ডান-পেলের সঙ্গে তুলনার প্রসঙ্গটাতেই যেটির পরিচয় পাওয়া গেল। এ নিয়ে কিছু বললেনই না। বিচারের ভার ছেড়ে দিলেন সাংবাদিকদের ওপর।

আলী–জর্ডান–পেলের সঙ্গে তুলনায় কোথায় থাকবেন, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতেই পারে। তবে এঁরা সবাই যে কিংবদন্তি, এ নিয়ে তো আর কোনো সংশয় নেই। একটা ক্ষেত্রে অবশ্য উসাইন বোল্ট এক এবং অনন্য। কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়ার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ আর কেউ বলে দিয়েছিলেন নাকি!