‘ভারপ্রাপ্তের ভারপ্রাপ্ত’ দিয়ে চলছে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর দেশের প্রায় সব ক্রীড়া ফেডারেশন ও সংস্থার পুরোনো কমিটি ভেঙে নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫০টি নতুন কমিটি ঘোষিত হলেও একমাত্র বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় রয়ে গেছে পুরোনো কমিটি।
শুধু তা-ই নয়, সাড়ে আট বছর ধরে এই সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে অ্যাডহক কমিটি দিয়ে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ১৯৯৬ সালে নির্বাচন পদ্ধতি আসার পর এত লম্বা সময় সরকার মনোনীত কমিটি দেখা যায়নি আর কোনো সংস্থা বা ফেডারেশনে।
অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কারের জন্য গঠিত সার্চ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২ মে। তার আগেই মহিলা ক্রীড়া সংস্থার প্রস্তাবিত কমিটি জমা দিয়েছে তারা সরকারের কাছে। কিন্তু কমিটি ঘোষণা হয়নি আজও।
সার্চ কমিটির আহ্বায়ক জোবায়দুর রহমান বিস্ময় নিয়ে বলছেন, ‘আমরা বিদায় নেওয়ার পরও সাড়ে চার মাস পার হয়েছে। আমি অবাক হচ্ছি, এখনো মহিলা ক্রীড়া সংস্থাটির কমিটি ঘোষণা না করায়। এর আগে শুটিংয়েও আমরা কমিটি দেওয়ার সাত-আট মাস পর তা ঘোষণা করা হয়।’
সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার ডানা চান দ্রুত নতুন কমিটি, ‘সাড়ে আট বছর ধরে অ্যাডহক কমিটি চলছে। সাত বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক—এটা বিস্ময়কর। দ্রুত নতুন কমিটি চাই আমরা।’
* সাড়ে আট বছর ধরে সংস্থা চলছে অ্যাডহক কমিটি দিয়ে
* সভানেত্রী-সাধারণ সম্পাদক দুজনই ভারপ্রাপ্ত
* ৩১ সদস্যের কমিটির অর্ধেকই নিষ্ক্রিয়
সরকার পরিবর্তনের পর গত বছর সেপ্টেম্বরে অন্যান্য ফেডারেশন সভাপতিদের মতো অব্যাহতি দেওয়া হয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভানেত্রী সাবেক হুইপ ও সাবেক অ্যাথলেট মাহবুব আরা গিনিকেও। ১ অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হন। এর আগে সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সভানেত্রীর দায়িত্ব পান সিনিয়র সহসভানেত্রী আনজুমান আরা আকসির। তবে ১৪ জুলাই থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিগত সফরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় দায়িত্ব দেন চতুর্থ সহসভানেত্রী ডা. ইসমত আরা হায়দারকে। ফলে কার্যত সংস্থাটি চলছে ‘ভারপ্রাপ্তেরও ভারপ্রাপ্ত’ সভানেত্রী দিয়ে।
সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পদটাও যাচ্ছে অদল-বদলের মধ্য দিয়ে। ২০১৭ সালের ৩ মার্চ নিয়মবহির্ভূতভাবে সাত সদস্যের পরিবর্তে গঠিত ৩১ সদস্যের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ষাটের দশকের অ্যাথলেট হামিদা বেগম। ২০২২ সালের মার্চে তিনি মারা যান। অসুস্থ থাকায় তাঁর মৃত্যুর আগে ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক প্রকৌশলী ফিরোজা করিম নেলী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। এখনো তিনিই দায়িত্বে আছেন।
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী কমিটির সভায় সৃষ্টি হয়েছে কোরাম-সংকট। রাজনৈতিক বিবেচনায় সংস্থায় জায়গা পাওয়া ব্যক্তিরা আর আসেন না। এমন ছয়জনের সঙ্গে সংস্থার এখন কোনো যোগাযোগই নেই। তিনজন সদস্য মারা গেছেন। গত ১৩ মাসে হওয়া সংস্থার চারটি সভায় এর প্রভাব পড়েছে। কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সাবেক অ্যাথলেট ফারহাদ জেসমিন লিটি জানিয়েছেন, কোরাম হতে অন্তত ১০ জনের উপস্থিতি লাগে। কিন্তু গত বছর ৫ আগস্টের পর কোনো সভাতেই সাত-আটজনের বেশি সদস্য আসেননি।
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ফিরোজা করিমের দাবি অবশ্য ভিন্ন। গতকাল সংস্থার কার্যালয়ে বসে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ১৮ জন সক্রিয় আছেন। তাঁরা ঘুরেফিরে আসেন। ৫ আগস্টের পর একটি সভায় শুধু কোরাম হয়নি। বাকিগুলোয় উপস্থিতি ভালো ছিল।’
মহিলা ক্রীড়া সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তারা প্রথম সারির ১৬টি খেলা পরিচালনা করছে। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল, সাঁতার, অ্যাথলেটিকস, টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। প্রতি মাসে অন্তত একটি করে খেলার টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টা থাকে বলে দাবি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের।
ধানমন্ডিতে রিয়া গোপ মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে ৯টি খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাঁতারই সংস্থার মূল আয়ের খাত। মাসে সাঁতার প্রশিক্ষণ থেকে আয় ১০ লাখ টাকার মতো। বিগত সরকার মহিলা ক্রীড়া সংস্থাকে ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা সেই অনুদান বেড়ে এখন ২৩ কোটি টাকা হয়েছে। ক্রিকেট ছাড়া দেশের আর কোনো ফেডারেশনের এত টাকা স্থায়ী আমানত নেই।
সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কয়েকজন সদস্যের অভিযোগ, গত সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাবে দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ‘স্বেচ্ছাচারী’ বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। কোনো জবাবদিহিও নাকি নেই। অভিযোগের বিষয়ে ফিরোজার ভাষ্য, ‘তাদের হয়তো আমাকে পছন্দ না। কমিটিতে এখন ১৮ জন সক্রিয়। তার মধ্য তিন-চারজন আমার বিরুদ্ধে বলতেই পারেন। তবে সংস্থা চলছে নিয়ম অনুযায়ী। সবকিছুরই জবাবদিহি আছে।’
নিজের যোগ্যতায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলেও দাবি তাঁর। এত লম্বা সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আছেন কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। সংস্থার ভালোর জন্য সরকার যা ভালো মনে করবে, তাই করবে।’
মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি পুনর্গঠনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না—জানতে চাইলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) পরিচালক (ক্রীড়া) আমিনুল এহসান বলেছেন, ‘এনএসসিতে নতুন নির্বাহী পরিচালক এসেছেন। তিনি নিশ্চয়ই বিষয়টা দেখবেন।’