ভয়ের খেলায় জয়ের নেশা উৎসবের
শৈশবে আর দশটা ছেলের মতো ছিলেন না উৎসব আহমেদ। মা–বাবার ভালোবাসার বাহুডোরে নিজেকে আটকে রাখতেন। রঙিন দুনিয়ায় সাদাকালো একটি টিভিই ছিল তাঁর বিনোদনের সঙ্গী। যেখানে কখনো নাটক, কখনো সিনেমা দেখেই সময় কাটত। মাঝেমধ্যে ফুটবল খেলাও দেখতেন। সে সময় বিটিভিতে সপ্তাহে এক দিন রেসলিং দেখানো হতো। যেটা দেখতে চাইতেন না উৎসব, মনের মধ্যে খানিকটা ভয় কাজ করত।
সেই উৎসবই এখন বক্সিং রিংয়ে নিয়মিত জয়োৎসব করছেন। শুধু তা–ই নয়, ২০০৯ সালে যখন বক্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার কথা মাকে প্রথম বলেছিলেন উৎসব, তাঁর মা শিল্পী খাতুন রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। ছেলেকে তখন বারণ করে বলেছিলেন, ‘মারামারিতে যেয়ো না। অন্য কিছু করো।’
উৎসবও তখন মায়ের কথায় খানিকটা ঘাবড়ে যান; কিন্তু ২০১০ সালে যখন তাঁর মামা জুয়েল আহমেদ এসএ গেমসে দেশকে সোনা উপহার দেন। তখনই বদলাতে থাকে দৃশ্যপট। উৎসবের মায়ের বক্সিং–ভীতিটাও কেটে যায়। উৎসবও তাঁর মামাকে দেখে কল্পনার আঙিনায় স্বপ্নের রং দিয়ে সাজান বক্সিংয়ের বর্ণিল এক জগৎ। সেই শুরু।
এরপর আর পিছু তাকাতে হয়নি, ‘একসময় আমি ফুটবল পছন্দ করতাম। এখনো মাঝেমধ্যে ফুটবল খেলা দেখি। নেইমার আমার প্রিয় ফুটবলার; কিন্তু মামাকে দেখার পর মনে হয়েছিল, বক্সিংয়ে দারুণ কিছু করতে পারব। যদিও এমন মারামারিকে আমি ভয়ই পেতাম। মাও চাননি আমি বক্সিংয়ে আসি। তিনিও এটাকে ভয় পেতেন।’
উৎসবের শুরুটা ২০১৭ সালে জাতীয় জুনিয়র বক্সিং দিয়ে। আর যাত্রাতেই রুপা জেতেন। তাতে আগ্রহটা আরও বাড়ে তাঁর। পরের বছর যুব বাংলাদেশ গেমসেও পান রুপা। ২০২১ সালে বিজয় দিবস বক্সিংয়ে তৃতীয় রুপা পান উৎসব। ২০২২ সালে স্বাধীনতা দিবসে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেখান আরেক চমক। শক্ত প্রতিপক্ষদের কাবু করে জেতেন সোনা।
২০২৩ সালে বিজয় দিবস বক্সিংয়ে নিজের দ্বিতীয় সোনার পদক গলায় পরেন উৎসব। একই বছর নিজ জেলা রাজশাহীতে অ্যামেচার বক্সিংয়েও সোনার সৌরভ ছড়িয়েছিলেন উৎসব। সেই পদকের পরই মূলত এলাকার মানুষের কাছে উৎসবকে নিয়ে নতুন করে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে বিকেএসপি কাপেও সেরার পদক সোনা জেতেন ২০ পেরোনো এই বক্সার।
সর্বশেষ গত রোববার ভুটানে চার জাতির আন্তর্জাতিক বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন বাংলাদেশের উৎসব। থিম্পুতে অনুষ্ঠিত ব্যান্টামওয়েট ক্যাটাগরিতে ৫৪ কেজির ফাইনালে নেপালের চন্দ্র থাপাকে হারিয়ে দেন আনসারের এই বক্সার। দেশের ফেরার পর কাল উৎসবকে সংবর্ধনা দিয়েছে বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশন। তাঁর এমন সাফল্যে খুশি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ কুদ্দুস খান, ‘উৎসব খুবই প্রতিভাবান বক্সার। তাঁর এমন অর্জনে আমরা আনন্দিত। ফেডারেশন থেকে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আপাতত আমরা সম্মানী হিসেবে তাকে ৫০ হাজার টাকা দেব।’
যে মামাকে দেখে বক্সিংয়ে এসেছিলেন উৎসব। সেই মামাও এখন রোমাঞ্চিত। এসএ গেমসের ইতিহাসে বক্সিং ডিসিপ্লিন থেকে এখন পর্যন্ত চারটি সোনা পেয়েছে বাংলাদেশ। যার একটি উৎসবের মামা জুয়েলের হাত ধরে। ২০১০ ঢাকা এসএ গেমসে লাইটওয়েট ওভার ৫৭ কেজি ওজন শ্রেণিতে সোনা জেতেন তিনি। যা তাঁর ক্যারিয়ারে সেরা অর্জনও। এত দিন সেই অর্জন নিয়ে গর্ব করে বলতেন জুয়েল। এবার নিজের ভাগনেকে দেখছেন নিজের আসনে। তাঁর বিশ্বাস, উৎসবও এসএ গেমসে সোনা জিতবেন, ‘একদিন সে আমার চেয়েও বড় বক্সার হবে। এসএ গেমসেও সোনা জিতবে। তার জন্য সব সময়ই আমার শুভকামনা।’