‘অলরাউন্ডার’ আয়েশার বাঁশি

আয়েশার স্বপ্ন, ঢাকার মাঠের মতো তাঁর বাঁশি একদিন বাজবে বিশ্বকাপেও
প্রথম আলো

বাবার চাওয়া ছিল মেয়েকে খেলা শেখাবেন। মা আবার সেটা চাইতেন না—খেলাধুলা করে কী হবে, পড়াশোনা শেষের পর বিয়ে দিয়ে দিলেই তো হয়! মায়ের ইচ্ছেও পূরণ করেছেন টাঙ্গাইলের মেয়ে আয়েশা পারভীন, তবে তার আগে পূরণ করেছেন বাবার ইচ্ছেটা। খেলেছেন, খেলার জগতে বিচরণ করতে করতেই হয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রথম নারী হকি আম্পায়ার। গত দুই বছর নিয়মিত ঘরোয়া হকির ম্যাচ পরিচালনা করছেন আয়েশা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সিঙ্গাপুরে পরিচালনা করেছেন মেয়েদের জুনিয়র এএইচএফ (এশিয়ান হকি ফেডারেশন) কাপ হকির ম্যাচও।

পড়ার টেবিলের চেয়ে খেলার মাঠই আয়েশাকে বেশি টানত। মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের নীল টার্ফে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘বাবা খেলাধুলায় খুব উৎসাহ দিতেন। তাঁর চাকরির সুবাদে আমার শৈশব কাটে দিনাজপুরে। সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলে পড়তাম। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটতাম জিমনেসিয়ামে। বাবা আমাকে সাইকেল চালানো শেখাতেন, জিমন্যাস্টিকস শেখাতেন।’

স্কুলে সব খেলাই খেলতেন আয়েশা। পরবর্তী জীবনেও হয়ে থাকলেন ‘অলরাউন্ডার’। স্কুলে পড়ার সময় দিনাজপুর মহিলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে অংশ নেন জাতীয় হ্যান্ডবলে। হ্যান্ডবল ছেড়ে পরে নাম লেখান জাতীয় আর্চারি দলে। খেলেছেন বাংলাদেশ গেমস এবং তুরস্কে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে। জাতীয় অ্যাথলেটিকসে শটপুটে সোনা, ডিসকাস থ্রো ও জ্যাভলিন থ্রোয়ে রুপা আছে তাঁর। খেলাধুলার পাশাপাশি খেলা নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন আয়েশা। ২০০৮ সালে বিকেএসপি থেকে নেন ব্যাচেলর অব স্পোর্টস ডিগ্রি।

আয়েশা বর্তমানে বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক। এই চাকরির সূত্রেই হয়েছেন হকির আম্পায়ার। গল্পটা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘প্রতিবছর দেশের সব শাহীন স্কুল নিয়ে আন্তশাহীন হকি টুর্নামেন্ট হয়। আমাদের কলেজের ছেলেদের খেলা শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। ভাবলাম, ভুল শেখানোর চেয়ে জেনে শেখানোই ভালো।’ ২০১৯ সালে হকি ফেডারেশনের আম্পায়ার্স কোর্সে অংশ নেন আয়েশা। কোর্সে অংশ নেওয়া ২২ জনের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। এরপর থেকেই ঢাকার হকি মাঠে বাঁশি বাজাচ্ছেন নিয়মিত। সদ্য সমাপ্ত শহীদ স্মৃতি হকিতেও আয়েশা ম্যাচ পরিচালনা করেছেন।

আয়েশার স্বপ্ন, ঢাকার মাঠের মতো তাঁর বাঁশি একদিন বাজবে বিশ্বকাপেও।
ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলা থেকেই আয়েশার ভয়ডর একটু কম। যেটা করতে মন চাইত, সেটাই করতেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। এ জন্য যখন যা শিখতে চেয়েছি, সমস্যা হয়নি। চাকরি ও ঘরসংসার সামলে এ পর্যন্ত আসতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।’

হকির আম্পায়ার আয়েশার আন্তর্জাতিক অভিষেক ২০১৯ সালে। বাংলাদেশের প্রথম নারী আম্পায়ার হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করেন সিঙ্গাপুরে মেয়েদের জুনিয়র এ এইচ এফ কাপে। আয়েশা বলছিলেন সেই রোমাঞ্চের কথা, ‘বিদেশে প্রথম বাঁশি বাজাতে হবে ভেবে হাত-পা কাঁপছিল। বাংলাদেশ থেকে একাই গিয়েছি। ভুল হলে দেশের মানসম্মান যাবে।’ ম্যাচ শেষের প্রতিবেদনে তাঁর প্রশংসাই করেছেন সেখানকার কর্মকর্তারা।

মেয়ে হয়ে আম্পায়ারিং করছেন বলে প্রতিবেশীদের সমালোচনা সইতে হয় আয়েশাকে। তবে শ্বশুরবাড়ি এবং স্বামী মোহাম্মদ সোলায়মানের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছেন সব সময়ই। নিজে হকির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়াতেই আয়েশা চান, বাংলাদেশে মেয়েদের হকিটা নিয়মিত হোক, ‘বাংলাদেশের মেয়েদের খেলা দেখে সিঙ্গাপুরে অন্য আম্পায়াররা প্রশংসা করত। সেসব শুনতেও বেশ ভালো লাগত। ফেডারেশন নিয়মিত মেয়েদের টুর্নামেন্ট করবে, এটাই চাওয়া। তাহলে আমরাও বেশি ম্যাচ পাব।’ আয়েশার স্বপ্ন, একদিন হকির বিশ্বকাপেও ম্যাচ পরিচালনা করতে নামবেন। তাঁর বাঁশিতে চলবে খেলা। লোকে দেখে বলবে, ‘ওই মেয়েটা বাংলাদেশের।’