অলিম্পিকের ওপর ছায়া ফেলছে গ্রীষ্মের দাবদাহ

ব্রাজিল-মেক্সিকো ম্যাচে দেখা গেছে রোদের উত্তাপছবি : রয়টার্স

আগস্ট মাসের প্রথমার্ধ জাপানে সাধারণভাবে হচ্ছে বছরের সবচেয়ে গরম সময়। তাপমাত্রা এই সময় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যায় এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ থাকে ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। সে কারণে এই সময়ে দিনের আলো থাকা অবস্থায় ঘরের বাইরে যাঁরা বের হন, তাঁদের সচরাচর হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। বছরের এ রকম এক সময়ে টোকিওতে অলিম্পিকের আয়োজন হওয়ায় ক্রীড়াবিদদের অবস্থা কী রকম দাঁড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমান করে নেওয়া সম্ভব।


অলিম্পিকের আয়োজকেরা এ কারণেই প্রতিযোগীদের যেখানে অনেক দূরের পথজুড়ে পাল্লা দিতে হয়, সে রকম দুটি ইভেন্ট জাপানের উত্তরের শহর হোক্কাইডোতে সরিয়ে নিয়েছেন। গ্রীষ্মে হোক্কাইডোর গড় তাপমাত্রা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে বলে, ম্যারাথন দৌড় এবং ৫০ কিলোমিটার দ্রুতগতির হাঁটার প্রতিযোগিতা টোকিওতে নয়, বরং সেই শহরে অনুষ্ঠিত হবে।

থম্পসন-হেরারা রোদের মধ্যেই গড়ছেন রেকর্ড
ছবি: রয়টার্স

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক নানা রকম প্রভাব প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর পড়তে থাকায় উত্তরের এলাকাগুলোও যে গ্রীষ্মে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে না, তা নিশ্চিত করে বলার উপায় এখন আর নেই। হোক্কাইডোর প্রধান শহর সাপ্পোরোতে যেমন এই গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ইতিমধ্যে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যেতে দেখা গেছে। এ কারণে প্রতিযোগীদের নিশ্চিতভাবেই প্রকৃতির আনুকূল্যের ওপর নির্ভর করতে হবে অনেক বেশি।


এদিকে টোকিওতে এখন অলিম্পিক চলতে থাকা অবস্থায় উন্মুক্ত জায়গায় যেসব প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেসব ইভেন্টের অংশগ্রহণকারীদের রীতিমতো ঘামে নেয়ে যাওয়া অবস্থায় মাঠে নামতে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া মধ্যদুপুরের প্রখর সূর্যতাপে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ইতিমধ্যে ঘটেছে। টেনিসের প্রতিযোগিতায় যেমন অংশগ্রহণকারীদের সম্মিলিত আহ্বানের মুখে মধ্যদুপুরের সব খেলা বেলা তিনটার পরে সরিয়ে নিতে আয়োজকেরা বাধ্য হয়েছিলেন।

সন্দেহ নেই, টোকিওর এই প্রচণ্ড গরমে সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পড়তে হচ্ছে অ্যাথলেটদের। মধ্যদুপুর থেকে পরের কিছু সময় পর্যন্ত সব রকম প্রতিযোগিতা বন্ধ রাখা হলেও সকাল ও বিকেলে গরমের দাপট কোনো অবস্থাতেই কম নয়। তারপরও মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে এবং এর মধ্য দিয়ে নতুন অলিম্পিক কিংবা বিশ্ব রেকর্ডও গড়ে উঠছে।


যেমন চমক দেখিয়েছেন নরওয়ের দৌড়বিদ কার্স্টেন ওয়ারহোম, পুরুষদের ৪০০ মিটার হার্ডলসে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে নিয়ে। নরওয়ে শীতের দেশ, টোকিওর এ রকম গরমের সঙ্গে যে দেশের মানুষের পরিচয় তেমন নেই। এ ছাড়া ওয়ারহোমের ইভেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছে টোকিওর স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার অল্প কিছু পরে, সূর্যের তাপ যখন থাকে সবচেয়ে প্রখর।

ফলে, দৌড় শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকেরা যখন তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন এই অসাধ্যসাধন তিনি কীভাবে করলেন, উত্তরে ওয়ারহোম বলেছেন, তাপমাত্রা এবং আবহাওয়া সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নিয়ে সে রকম কৃত্রিম পরিবেশে দিনের পর দিন তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফলে, খুব বেশি কঠিন এটা তাঁর কাছে মনে হয়নি।

কারস্টেন ওয়ারহোম
ছবি : রয়টার্স

ওয়ারহোম নিশ্চয় ব্যতিক্রমী এক ক্রীড়াবিদ। তবে অলিম্পিকের অধিকাংশ অ্যাথলেটদের সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি বলে গরম তাঁদের ভোগাচ্ছে। আয়োজকেরা অবশ্য মাঠের ভেতরেও ঠান্ডা রাখার নানা ব্যবস্থা তৈরি রেখেছেন। ক্রীড়াবিদদের সময় কাটানোর জন্য যেসব আচ্ছাদন মাঠে বসানো হয়েছে, সেখানে আছে দেহ শীতল রাখার নানা ব্যবস্থা। ফলে প্রতিযোগিতা চলার বাইরে খুব বেশি অসুবিধায় যে অ্যাথলেটদের পড়তে হচ্ছে, তা অবশ্য নয়।


অন্যদিকে, সবচেয়ে অসুবিধাজনক অবস্থায় আছেন অলিম্পিকের সেসব স্বেচ্ছাসেবী, খোলা জায়গায় যাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অ্যাথলেটদের মতো সুবিধার কোনো ব্যবস্থা তাঁদের জন্য না থাকায় স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। আয়োজকেরা জানিয়েছেন গতকাল সোমবার পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার যে ৩০টি ঘটনা অলিম্পিকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর শিকার স্বেচ্ছাসেবীরাই।

তবে তা সত্ত্বেও গরমে কষ্ট পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কোনো ঘটনা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। স্বেচ্ছাসেবীদের সবাই অলিম্পিকে আসাকে অল্প সময়ের মধ্যে হতে যাওয়া বিরল এক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখছেন। ফলে কষ্ট হলেও সেই কাজ তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছেন।

টোকিও অলিম্পিক নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে
ছবি: এএফপি

টোকিওতে যখন সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে, সেই সময়কে কেন অলিম্পিকের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্ন অনেকে করছেন। বিশেষ করে ১৯৬৪ সালের অলিম্পিক অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত সামনে থাকায় এ প্রশ্ন মনে স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। সময় নির্ধারণের পেছনে জাপান সরকার কিংবা টোকিওর আয়োজকদের কোনো ভূমিকা নেই। এটা এককভাবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) ওপর নির্ভরশীল। খেলাধুলা আজকাল বাণিজ্যের পণ্য হয়ে ওঠায় সম্প্রচার অধিকার বিক্রি করার মধ্যে দিয়ে কত বেশি অর্থ উপার্জন করা যায়, সেদিকে আইওসির নজর সবচেয়ে বেশি। ফলে অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের চেয়ে সম্প্রচার কোম্পানিগুলোর চাহিদার দিকে আইওসিকে অনেক বেশি নজর দিতে হয়।

বছরের অন্যান্য সময়ে অন্য খেলা প্রচারের অধিকার অনেক সম্প্রচার কোম্পানি আগে থেকে কিনে নেওয়ায় এদের দাবি ছিল, বছরের বিশেষ এই সময়ে যেন টোকিও অলিম্পিকের আয়োজন করা হয়। ফলে ক্রীড়াবিদ কিংবা অন্যদের সুবিধা–অসুবিধা তাঁদের কাছে বিবেচ্য বিষয় ছিল না।


অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই খেলাধুলারও পণ্য হয়ে ওঠা কিছু ক্রীড়াবিদদের জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে এলেও সার্বিকভাবে খেলার জগতের ওপর নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ চলার সময়ে টোকিওতে অলিম্পিকের আয়োজনও সে রকম একটি নেতিবাচক দিক।