অলিম্পিকের বছরে আছেন জোকোভিচ-ভেরস্টাপেনও

শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২১। ক্রীড়াঙ্গনে কেমন গেল বিদায়ী বছরটা? পেছন ফিরে তাকালে উঠে আসে হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কত উপাখ্যান! সেসব নিয়েই ধারাবাহিক এই বর্ষপরিক্রমা। আজ থাকছে আন্তর্জাতিক অন্যান্য খেলা।

অলিম্পিক মার্চে বাংলাদেশ দলছবি: রয়টার্স

২০২০ সালে পুরো পৃথিবীর মতো থমকে গিয়েছিল ক্রীড়াঙ্গনও। করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই পৃথিবী যেমন ধীরে ধীরে ফিরে এসেছে নতুন স্বাভাবিকতায়, তেমনি ক্রীড়াঙ্গনেও ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। ২০২০ সালে অলিম্পিক, ইউরো ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো বড় প্রতিযোগিতাগুলো বাধ্য হয়েই স্থগিত করতে হয়েছিল। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আসর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ২০২১ সালেও হতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। তবে শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো ঝামেলা ছাড়াই দর্শকবিহীন স্টেডিয়ামে সফলভাবেই শেষ হয়েছে টোকিও অলিম্পিক।

সেই অলিম্পিকও কম নাটক উপহার দেয়নি। শুধু কি অলিম্পিক; টেনিস, ফর্মুলা ওয়ান, বক্সিং, গলফসহ প্রায় সব ধরনের খেলাতেই বলার মতো কত ঘটনা! মার্চেল ইয়াকবসের মতো অখ্যাত দৌড়বিদের বিশ্বের দ্রুততম মানব হয়ে যাওয়া, নোভাক জোকোভিচের গ্র্যান্ড স্লাম জয়ে ফেদেরার-নাদালের পাশে বসা, বছরের শেষ গ্রাঁ প্রির শেষ ল্যাপের মহা নাটকীয়তায় মাক্স ভেরস্টাপেনের চ্যাম্পিয়ন হওয়া—সারা জীবন মনে রাখার মতো কত ঘটনা এই বছরে!

টোকিও অলিম্পিক

অলিম্পিকের দ্রুততম মানব মার্চেল ইয়াকবস
ফাইল ছবি

এক বছর পিছিয়ে যাওয়া অলিম্পিকের সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছিল। জাপানে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছিল করোনার। তবে ২৩ জুলাই টোকিও অলিম্পিক স্টেডিয়ামে জাপানি টেনিস তারকা নাওমি ওসাকা অলিম্পিক শিখা প্রজ্বালন করতেই উধাও সব সংশয়। গ্যালারিতে সাধারণ দর্শকের উপস্থিতি না থাকলেও রোমাঞ্চের কমতি ছিল না।

অ্যাথলেটিকসে টোকিও অলিম্পিকের আগে কে জানতেন মার্চেল ইয়াকবসের নাম? অখ্যাত এই ইতালিয়ান স্প্রিন্টারই কিনা দখল করলেন উসাইন বোল্টের ফেলে যাওয়া দ্রুততম মানবের খেতাব। মেয়েদের স্প্রিন্টে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ১০০ ও ২০০ মিটারের দ্বিমুকুট জেতেন জ্যামাইকান তারকা এলেইন টম্পসন-হেরা। ১০০ মিটারটা ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা সময়ে জিতে প্রয়াত ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ-জয়নারকেও মনে করিয়ে দিয়েছেন টম্পসন-হেরা। অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে দুটি বিশ্ব রেকর্ড দেখেছে, দুটিই ৪০০ মিটার হার্ডলসে। পুরুষ বিভাগে নরওয়ের কারস্টেন ওয়ারহোম ও মেয়েদের বিভাগে সিডনি ম্যাকলোফলিন গড়েছেন হার্ডলসের নতুন দুই রেকর্ড।

সাঁতারে ব্যক্তিগত ইভেন্টে দুটি সোনা জিতে যুক্তরাষ্ট্রের নারী সাঁতারু কেটি লেডেকি ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। অলিম্পিকে সব মিলিয়ে ব্যক্তিগত ইভেন্টে ছয়টি সোনা জিতেছেন লেডেকি। ব্যক্তিগত ইভেন্টে ছয়টি সোনাজয়ী প্রথম সাঁতারু তিনিই।

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বের অলিম্পিকে সবচেয়ে বড় আলোচনা অবশ্য জন্ম দিয়েছেন সিমোন বাইলস। যুক্তরাষ্ট্রের নারী জিমন্যাস্ট বড় কীর্তি গড়তে গিয়েছিলেন টোকিওতে। কিন্তু ‘টুইস্টিস’ নামে মানসিক সমস্যায় ভুগে শেষ মুহূর্তে বেশ কটি ইভেন্ট থেকেই নাম প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বাইলস।

ফেদেরার-নাদালকে ছুঁয়েছেন নোভাক জোকোভিচ
ফাইল ছবি

জোকোভিচের বছর

অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ও ফ্রেঞ্চ ওপেনের পর উইম্বলডন—বছরের প্রথম তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম জিতেই রেকর্ডের পাতায় নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেন নোভাক জোকোভিচ। উইম্বলডন জিতে সার্বিয়ান তারকা পেয়ে যান ক্যারিয়ারের ২০তম গ্র্যান্ড স্লাম একক শিরোপা। তাতে গ্র্যান্ড স্লাম জয়ে রজার ফেদেরার ও রাফায়েল নাদালের মতো দুই কিংবদন্তির পাশে বসে যান জোকোভিচ। আর একটি গ্র্যান্ড স্লাম জিতলেই ফেদেরার-নাদালকে ছাড়িয়ে ইতিহাস। জোকোভিচের সামনে হাতছানি ছিল ক্যালেন্ডার গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের, এমনকি অলিম্পিকের সোনাসহ গোল্ডেন স্লাম জয়েরও। কিন্তু সবকিছু তো আর চিত্রনাট্য মেনে হয় না। জোকোভিচও পারেননি। অলিম্পিকের সেমিফাইনালে জার্মানির আলেক্সান্দার জভেরেভের কাছে হেরে ভাঙে গোল্ডেন স্লামের স্বপ্ন। সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ডটাও হয়নি। ইউএস ওপেনের ফাইনালে রাশিয়ার দানিল মেদভেদেভের কাছে হেরে অপেক্ষাটা আরও বাড়িয়েছেন জোকোভিচ।

জোকোভিচের বছরে মেয়েদের বিভাগে আলোচিত নাম দুটি—নাওমি ওসাকা ও এমা রাদুকানু। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের চেয়েও ওসাকা বেশি আলোচনায় ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে না চেয়ে ও মানসিক অবসাদের কারণে সরে দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে রূপকথা লিখেই ইউএস ওপেন জিতেছেন বাছাইপর্ব পেরিয়ে আসা ১৮ বছর বয়সী ব্রিটিশ খেলোয়াড় রাদুকানু।

ফর্মুলা ওয়ানের নতুন চ্যাম্পিয়ন মাক্স ভেরস্টাপেন
ফাইল ছবি

হ্যামিল্টনের দুঃখ, ভেরস্টাপেনের হাসি

জোকোভিচের মতো ইতিহাসের হাতছানি ছিল লুইস হ্যামিল্টনের সামনেও। আবুধাবিতে বছরের শেষ গ্রাঁ প্রিটা জিতলেই মাইকেল শুমাখারকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার রেকর্ড গড়তেন ব্রিটিশ তারকা। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। এক রেসার দুর্ঘটনায় পড়ায় সার্কিটে ঢুকে যায় সেফটি কার। এই সুযোগে নতুন চাকা বসে যায় প্রতিদ্বন্দ্বী মাক্স ভেরস্টাপেনের গাড়িতে।

সেফটি কার ঢোকার আগে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকা হ্যামিল্টন শেষ ল্যাপের আগেও এগিয়ে ছিলেন ভেরস্টাপেনের চেয়ে। এরপর যা হলো, সেটিকে পাগলামি ছাড়া আর কীই–বা বলা যায়! নতুন চাকা ও নিয়মের ফাঁক গলে কী গতির ঝড়ই না তুললেন ডাচ তারকা। অবিশ্বাস্যভাবে হ্যামিল্টনকে টপকে আবুধাবি গ্রাঁ প্রি জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভেরস্টাপেন। ‘বিতর্কিত’ভাবে হেরে যাওয়া হ্যামিল্টন এতটাই মুষড়ে পড়েছেন এ ঘটনায় যে কাছের মানুষেরা বলছেন, আর কখনো রেসিং ট্র্যাকে না–ও দেখা যেতে পারে তাঁকে।