আনন্দের বিশ্বমুকুটে যে ‘সূর্যের’ আলো

দাবার বোর্ডে সূর্যশেখর গাঙ্গুলি

টেলিভিশনে রামায়ণের সিরিয়াল দেখে তির-ধনুক বানাতেন। এরপর সেই খেলনা তির ছুড়ে মারতেন মানুষের গায়ে। ছোট্ট সূর্যশেখর গাঙ্গুলিকে এই দুষ্টুমি থেকে সরিয়ে আনতে দাদু অনিল বসুমল্লিক নাতির হাতে দাবার বোর্ড ধরিয়ে দেন। দাদুর ধরিয়ে দেওয়া সেই নেশায় বুঁদ হয়েই সূর্যশেখর আজ ভারতের অন্যতম গ্র্যান্ডমাস্টারদের একজন। ঢাকায় চলমান প্রিমিয়ার লিগে তিনি খেলছেন বাংলাদেশ পুলিশের হয়ে।

ভারতের গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথন আনন্দ পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এর তিনবারই বড় অবদান ছিল সূর্যশেখরের। ২০০৮, ২০১০ ও ২০১২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ভ্লাদিমির ক্রামনিক, বুলগেরিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার ভেসেলিন তোপালভ, ইসরায়েলের বরিস গেলফান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে আনন্দের সহকারী হিসেবে কাজ করেন সূর্যশেখর। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে খেলোয়াড়দের সঙ্গে চারজনের একটা দল কাজ করে, এটাকে বলা হয় ‘টিম অব সেকেন্ডস’। আনন্দের ওই দলে ছিলেন সূর্যশেখর। ঢাকায় প্রিমিয়ার দাবা লিগে খেলতে এসে ৩৯ বছর বয়সী কলকাতার গ্র্যান্ডমাস্টার প্রথম আলোকে বলছিলেন সেই অভিজ্ঞতার কথা, ‘আমি আনন্দের সহকারী এবং কোচের মাঝামাঝি একটা ভূমিকায় কাজ করেছি। ২০০৮ সাল থেকে যতবার তার সহকারী ছিলাম ততবারই আনন্দ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আনন্দের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো ছিল চমৎকার।’

আনন্দকেই বরাবর আদর্শ মানেন ৩৯ বছর বয়সী কলকাতার এই দাবাড়ু। সেই আনন্দের কাছ থেকেই সহকারী হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাঁর, ‘আনন্দ একদিন ফোন করে বলেন, দাবার কিছু নির্দিষ্ট ওপেনিং নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কাজ করতে চান। বললেন, ২০০৮ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ক্রামনিকের বিপক্ষে ম্যাচে তাঁকে সাহায্য করতে পারব কি না? আমার জন্য প্রস্তাবটা অবিশ্বাস্যই ছিল। আমার মনেই হয়নি যে আমি ওঁর সঙ্গে কাজ করার মতো তেমন উপযুক্ত হয়েছি। প্রস্তাব পেয়ে তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই।’

আনন্দের অর্জনে নিজের নাম জড়িয়ে থাকায় গর্বই হয় সূর্যশেখরের, ‘খুবই দায়িত্বশীল কাজ ছিল সেটা। আমার একটা পরিকল্পনায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে খেলা হচ্ছে, এটা অনেক ভালো লাগার মতো ব্যাপার।’

আনন্দের সঙ্গে থাকার পাশাপাশি সূর্যশেখর নিজেও খেলেছেন বিশ্বের সেরা দাবাড়ুদের বিপক্ষে। তিনি বলছিলেন সে অভিজ্ঞতার কথাও, ‘কার্লসেন, আনন্দ, অ্যারোনিয়ান, জিভলারদের মতো বিশ্বসেরাদের সঙ্গে খেলে অনেক কিছু শেখা যায়। যা শিখেছি তা পরে নিজের খেলায় কাজে লাগিয়েছি।’

ভারতের ছয়বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সূর্যশেখর ঘরোয়া, আন্তর্জাতিক মিলিয়ে জিতেছেন ৪০টি সোনার পদক। ২০১৯ সালে কাজাখস্তানে বিশ্ব দলগত চ্যাম্পিয়নশিপে এককে জেতেন সোনা। ব্যাংকক ওপেন, হুনান ওপেন, ক্যানবেরা ওপেনেও জিতেছেন সোনা। তবে এই সব অর্জনের মধ্যে তিনি সবার ওপরে রাখেন ভারতের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম স্বীকৃতি অর্জুন পুরস্কারকে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার স্মৃতিটা কখনো ভুলবেন না সূর্যশেখর, ‘অর্জুন পুরস্কার ছিল আমার জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। এটা এমন একজনের কাছ থেকে পেয়েছি, স্যার এ পি জে আবদুল কালাম! ওই স্মৃতি কখনোই ভুলব না।’

দাবা সূর্যশেখরকে দিয়েছে মুঠোভরে স্বীকৃতি, সম্মান। অথচ জীবনের একপর্যায়ে কি না চেয়েছিলেন এই খেলাটাই ছেড়ে দিতে! ‘আমি খুব দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা ছিল আমাদের। ট্রাম দুর্ঘটনায় আমার দিদির একটা পা কাটা যায়। এরপর থেকে আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। বাবা প্রচুর দেনায় জড়িয়ে পড়েন। আমি তখন সবে জাতীয় দলে ঢুকেছি। তবু টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকতাম। এমনকি এটাও জানতাম না খেলতে যাওয়ার গাড়িভাড়াটা থাকবে কি না। ওই সময় খেলার সুবাদে ইন্ডিয়ান অয়েলে চাকরি হলো। ওরা এগিয়ে না এলে হয়তো খেলাই ছেড়ে দিতাম।’

দাবা খেলার বাইরে জাদুবিদ্যারও নেশা আছে সূর্যশেখরের। কোথাও খেলতে গেলেও জাদু দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। তবে আসল জাদুটা তিনি দেখাতে পছন্দ করেন দাবার বোর্ডেই, প্রতি চালেই যেখানে বিভ্রান্ত করতে চান প্রতিপক্ষকে।