আসছে শরণার্থী অলিম্পিক দল, নেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধিত্ব

শরণার্থী দল ঘোষণা করছেন টমাস বাখ।ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণ চলতে থাকা অবস্থায় টোকিও অলিম্পিকের আয়োজন নিয়ে তর্ক–বিতর্কের শেষ এখনো দেখা যাচ্ছে না। তবে করোনার কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া ২০২০ অলিম্পিকের নির্ধারিত সময়সূচি যত এগিয়ে আসছে, এত দিন পর্যন্ত ভারী থাকা অলিম্পিক আয়োজনের বিপক্ষের জনমত জাপানে তত হালকা হয়ে আসছে।

দেশজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে যেতে থাকায় এত দিন যাঁরা অলিম্পিক আয়োজনের বিরোধিতা করে আসছিলেন, তাঁদের একটি অংশও এখন দৃশ্যত এ রকম মনে করছে যে অলিম্পিক হয়তো ইতিমধ্যে নিয়তিনির্ধারিত হয়ে যাওয়া এক সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) পাশাপাশি টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটিও এখন সব রকম আয়োজন সময়মতো শেষ করতে তৎপরতা জোরদার করছে।

প্রস্তুতির এই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে আইওসি গতকাল অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়া শরণার্থী অলিম্পিক দলের নাম ঘোষণা করেছে। ২৯ জন ক্রীড়াবিদকে নিয়ে গড়া এই দল সারা বিশ্বের শরণার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবে। আইওসি আশা করছে, এই উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বিশ্ববাসীকে কিছুটা হলেও বেশি সচেতন করে তোলা যাবে।

যে শরণার্থী ক্রীড়াবিদেরা বর্তমানে আইওসির অলিম্পিক বৃত্তি ও শরণার্থী ক্রীড়াবিদ কর্মসূচির সহায়তা পাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে শরণার্থী দলের সদস্যদের বাছাই করে নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি অনেক দিন ধরে এই কর্মসূচি চালিয়ে গেলেও ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো শরণার্থী ক্রীড়াবিদদের একটি দল অলিম্পিকে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ১০ সদস্যের সেই শরণার্থী অলিম্পিক দলের অংশগ্রহণ প্রতীকী ছিল ঠিকই, তবে এ কারণে সেটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণের একটি পথ তৈরি করে দেওয়া হয়। সেই দলের ছয়জন এবার টোকিও অলিম্পিকেও যোগ দিচ্ছেন।

রিও অলিম্পিকের সফল সেই উদ্যোগের পর আইওসি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে শরণার্থী ক্রীড়া কর্মসূচির জন্য অলিম্পিক বৃত্তি চালু করে। এ পর্যন্ত ৫৬ জন ক্রীড়াবিদকে সেই বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।

তবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জনের মাপকাঠি শরণার্থী ক্রীড়াবিদদের বেলাতেও একই থাকছে। ভিন্নভাবে আয়োজন করা হলেও যোগ্যতা প্রমাণের জন্য আয়োজিত বিভিন্ন পর্যায়ের বাছাইপর্ব পার হয়েই এই ক্রীড়াবিদদের আসতে হয়।

শরণার্থী দলের ২৯ জন।
ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ গতকাল এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে শরণার্থী অলিম্পিক দলের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ২৯ জনের মধ্যে ১০ জন হচ্ছেন সিরিয়ার শরণার্থী। সংখ্যার বিচারে এরপর যথাক্রমে আছেন ইরান, দক্ষিণ সুদান ও আফগানিস্তানের শরণার্থীরা। বিভিন্ন দেশের শরণার্থীশিবিরে একসময় আশ্রয় নিলেও এখন তাঁরা স্বাগতিক দেশের অলিম্পিক কমিটির তত্ত্বাবধানে আছেন।

অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজ নিজ দেশের পতাকা নয়, বরং অলিম্পিক পতাকা বহন করবেন এই শরণার্থী অ্যাথলেটরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্টেডিয়ামে ঢোকার ক্ষেত্রেও এই দলের জন্য থাকছে বিশেষ নিয়ম। বর্ণমালার ক্রমানুসারে নয়, বরং সবার আগে গ্রিসের জাতীয় দলের স্টেডিয়ামে ঢোকার যে ঐতিহ্য অলিম্পিক অনুসরণ করে আসছে, সেটা ঠিক রেখে এরপরই শরণার্থী দল স্টেডিয়ামে ঢুকবে।

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচিত শরণার্থী ক্রীড়াবিদদের অভিনন্দন জানিয়ে আইওসির প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের জাতীয় অলিম্পিক কমিটির ক্রীড়াবিদদের পাশাপাশি আইওসির শরণার্থী অলিম্পিক দল যখন জুলাই মাসের ২৩ তারিখে টোকিওতে সমবেত হবে, সেটা বিশ্বজুড়ে মৈত্রী, দুর্যোগ প্রতিহত করা এবং আশার বলিষ্ঠ বার্তা ছড়িয়ে দেবে।

বিশ্বে শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় এক সমাবেশ যে জাতিসত্তাকে ঘিরে, সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের কোনো সুযোগ সেখানে একেবারেই হয়নি।

একই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডিও অনলাইনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, শরণার্থী দলের অলিম্পিকে অংশগ্রহণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে নিজেদের দক্ষতা তুলে ধরার সুযোগ অবহেলিত লোকজনকে দেওয়া হলে সারা বিশ্বের সামনে নিজেদের সম্ভাবনার প্রমাণ তুলে ধরতে তাঁরা সক্ষম।

বাখ ও গ্রান্ডি দুজনই উল্লেখ করেন যে শরণার্থী অলিম্পিক দল গঠনের ক্ষেত্রে তাঁরা চেষ্টা করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত লোকজনের সমতামূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে। তবে বিশ্বে শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় এক সমাবেশ যে জাতিসত্তাকে ঘিরে, সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের কোনো সুযোগ সেখানে একেবারেই হয়নি। কোন হিসাব এর পেছনে কাজ করেছে, তা অবশ্য পরিষ্কার নয়।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এমনিতেও শরণার্থী হিসেবে অনেকটাই অবহেলিত। তাঁদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা একসময় যারা পালন করেছিল, সেই দস্যুর দল এখন হঠাৎ আন্তর্জাতিক রাজনীতির পালের গোদাদের কাছে নায়ক হিসেবে নতুন করে পরিচিতি লাভ করছে। এ কারণে রোহিঙ্গারা এখন যেন হয়ে পড়েছেন আরও বেশি অবহেলিত ও বিস্মৃত।