কাঁচা আমের ভর্তা আর বিলবোর্ডের মাবিয়া

পদক জিতে এভাবেই বারবার উচ্ছ্বাসে ভেসেছেনে মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
পদক জিতে এভাবেই বারবার উচ্ছ্বাসে ভেসেছেনে মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলোতেও আছেন অনেক বড় তারকা । সাফল্যের আলো জ্বেলেই নিজেদের অঙ্গনে আলোকিত তাঁরা । ছোট খেলার সেই সব বড় তারকাদের নিয়েই এই ধারাবাহিক। আজ দ্বিতীয় পর্বে থাকছে ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তারের তারকা হয়ে ওঠার গল্প—


সৌভাগ্যের সংখ্যা ৭ ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তারের জীবনে বার বারই মিলে যায়। ৭ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। ৭ ফেব্রুয়ারি জেতেন ক্যারিয়ারের প্রথম এসএ (দক্ষিণ এশিয়ান) গেমস সোনা। এসএ গেমসে দ্বিতীয় সোনা আসে ৭ ডিসেম্বর। মাবিয়ার জীবনের গল্পটা যেন সাতের পাকেই বাঁধা!

লাউড স্পিকারে বাজছে, 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...', টেলিভিশনের পর্দায় মাবিয়ার অঝোরে কান্নার দৃশ্য—বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসেরই একটা অংশ এখন এটি। মাবিয়ার সেই কান্না ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের গুয়াহাটিতে এসএ গেমসে সোনা জেতার পর। অথচ হাতের চোটের কারণে সেদিন খেলারই কথা ছিল না তাঁর! চোট একটু কমতেই উঠে যান ভার তোলার মঞ্চে। বাকিটা ইতিহাস।
ভারোত্তোলন অলিম্পিকের একটি ইভেন্ট হলেও বাংলাদেশে এটি কখনোই তেমন জনপ্রিয় খেলা ছিল না।এ দেশে ছিল না খেলাটির কোনো তারকা। কিন্তু হাওয়া বদলে দিল মাবিয়ার ওই সোনা জয় এবংবিজয় মঞ্চের কান্না। সাধারণ মানুষের কাছে খেলাটাকে নতুন করে চেনান তিনি। এখন রাস্তাঘাটে, কোনো শপিং মলে বা কফি শপে ঢুকলে মাবিয়াকে দেখেও লোকে ফিসফিস করে বলে, 'ওই যে যাচ্ছে মাবিয়া ।' আগে এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে মেয়েদের ইভেন্টই ছিল না । ২০১৬ সালেই প্রথমবার মেয়েদের ইভেন্ট অন্তর্ভুক্ত হয় গেমসে। প্রথম আসরেই বাজিমাত করেন মাবিয়া।
এসএ গেমসে টানা দুই আসরে ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা জয়ের রেকর্ডও মাবিয়ার আগে কোনো নারী খেলোয়াড়ের ছিল না। নেপালে গত বছর ডিসেম্বরে হওয়া সর্বশেষ এসএ গেমসে সোনা জিতে রেকর্ডটি নিজের করে নেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের কমতি নেই মাবিয়ার। কাতারে এশিয়ান ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন সোনা। সোনার পদক জিতেছেন পুনেতে কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে। মিশরে ইসলামিক সলিডারিটি চ্যাম্পিয়নশিপ, উত্তর কোরিয়ায় জুনিয়র এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, উজবেকিস্তানে আফ্রো এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও মালয়েশিয়ায় কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন রুপা। ব্রোঞ্জ জিতেছেন থাইল্যান্ডের কিংস কাপে ও নেপালে প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে। অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে হয়েছেন ষষ্ঠ, যা এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশী ভারোত্তোলকের সেরা ফল। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি জাতীয় প্রতিযোগিতায় মাবিয়াই জিতেছেন সোনার পদক।

টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে ব্যস্ত ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে ব্যস্ত ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

টেলিভিশনে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে যেখানে ক্রিকেটারদেরই দেখা মেলে বেশি, সেখানেও জায়গা করে নিয়েছেন ভারোত্তোলন কন্যা মাবিয়া। এরই মধ্যে স্কয়ারের জয়া স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং রান এনার্জি বারের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন। বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব ছিল আরও। কিন্তু শুটিংয়ে সময় দিতে গিয়ে অনুশীলনের ছন্দপতন হয় বলে ইদানিং টিভি বিজ্ঞাপনে আগ্রহ দেখান না। তারপরও রাস্তার ধারের বিলবোর্ডে কিংবা টিভিতে যখন ভেসে ওঠে নিজের চেহারা, মনের অজান্তেই মাবিয়ার মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করে, 'ময়মনসিংহ, বান্দরবান, রাঙামাটি, রংপুরের অনেক রাস্তার ধারে জয়া স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনে আমার ছবি লাগানো । সেগুলো দেখে অনেক পরিচিত মানুষ ফোন দেয়। তখন ভালো লাগে। আনসার একাডেমি থেকে ফেরার পথে গাজীপুরের রাস্তার বিলবোর্ডে নিজের ছবি দেখেছি। সাকিব ভাইদের মতো বিজ্ঞাপনে নিজেকে দেখতে আনন্দই লাগে।'

এসএ গেমসে খেলার ফাঁকে নেপালের পোখারায় ফেওয়া লেকে মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
এসএ গেমসে খেলার ফাঁকে নেপালের পোখারায় ফেওয়া লেকে মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

ছোট খেলার হলেও তারকা তো বড়! মাবিয়াকে ভক্তদের আবদারও মেটাতে হয় অহরহ । এক ভক্তের মজার কান্ডের কথা বলতে গিয়ে হেসে দিলেন তিনি, ' একবার আমার এলাকায় এক কফি শপে ঢুকেছি । কফি খাওয়া শেষে বান্ধবীদের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে দৌড়ে এসে একটি ছেলে বলল, আপু আপনার কান্নার সেই ভিডিওর ছবি ফেসবুকের প্রোফাইলে রেখেছি। আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। একটা ছবি তুলতে চাই আপনার সঙ্গে।'

টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের শুটিং করতে গেলে একবার গ্রামের মেয়েরা মাবিয়ার জন্য কাঁচা আমের ভর্তা বানিয়ে এনেছিল। মানুষের এমন ভালোবাসায় মুগ্ধ মাবিয়া, 'ভারোত্তোলন খেলা ততটা জনপ্রিয় না আমাদের দেশে । কিন্তু সাধারণ মানুষ যে আমাকে এতটা ভালোবাসে, আমাকে চেনে এটা ভাবতেও ভীষণ ভালো লাগে।'

ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বেড়াতে গিয়ে তাজমহলের সামনে মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বেড়াতে গিয়ে তাজমহলের সামনে মাবিয়া আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহও পেয়েছেন মাবিয়া । যখনই কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সাফল্য পান তখনই ডাক পড়ে গণভবনে। এ পর্যন্ত পাঁচবার দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। মাবিয়া বলছিলেন, 'কিছু দিন আগে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) এসএ গেমসে সোনাজয়ী অ্যাথলেটদের হাতে ফ্ল্যাট ভাড়ার টাকা তুলে দেন । সেদিন সবার সামনে বললেন, ও আমার সন্তান। তোমরা দেখো কথা দিয়ে কিভাবে কথা রেখেছে মাবিয়া। এরপর বললেন, সব সময় নিজের খেলার প্রতি মনোযোগ রাখবে।' গুয়াহাটি এসএ গেমসে সোনা জেতার পর কাঠমান্ডু গেমসে তা ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাবিয়া । তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি রাখার কথাটাই সবাইকে সেদিন শোনান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মাবিয়ার প্রতিশ্রুতি আছে আরও। দেশকে একের পর এক সাফল্য উপহার দিয়ে ছাড়িয়ে যেতে চান নিজেকেই।