খেলার সুরে বাঁধা এক পরিবার

বোন, মা, ভাই, ভাবী, বাবা—এভাবে বলতে না চাইলে ‘সাঁতারু, অ্যাথলেট,সাঁতারু, সাঁতারু, ফুটবলার’—এভাবেও পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন এই পরিবারকে।ছবি: তৌহিদী হাসান

আশপাশের আট–দশ গ্রামের মধ্যে কুষ্টিয়ার সাঁতারের গ্রাম আমলা একটু আলাদাই। সেই গ্রামের মধ্যেই আবার আলাদা বিশেষ একটি পরিবার। যে পরিবারের দুর্দিনে একসময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন স্বজনেরা, আজ সেই পরিবারটি গ্রামের সবার জন্য আদর্শ উদাহরণ।

গল্পটা জাতীয় সাঁতারু আসিফ রেজার পরিবারের। আসিফদের বাড়িকে খেলাপাগল বাড়ি বললে ভুল হবে না। নৌবাহিনীর সাঁতারু আসিফের মা মর্জিনা খাতুন ছিলেন বিজেএমসির অ্যাথলেট। নব্বইয়ের দশকে বিজেএমসির হয়ে খেলতেন শটপুট ও ডিসকাস থ্রো। মর্জিনা অংশ নিয়েছেন বয়সভিত্তিক জাতীয় সাঁতারেও। ২০০৪ সালে এক মৌসুম খেলেছেন ফুটবল।

আসিফের বাবা আনোয়ার হোসেনও ফুটবলার ছিলেন। কুষ্টিয়া জেলা ফুটবল লিগে প্রায় পাঁচ বছর খেলেছেন সূর্যশিখা স্পোর্টিং ক্লাবের স্ট্রাইকার হিসেবে।

আসিফ রেজা ও সোনিয়া আক্তার।
ছবি: প্রথম আলো

আসিফের বোন বিকেএসপির সাঁতারু খাদিজা আক্তার জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে জিতেছেন মোট ১২টি সোনা। ২০১৮ সালে সর্বশেষ জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ৫০ ও ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে অংশ নেন খাদিজা। আসিফের স্ত্রী সোনিয়া আক্তারও জাতীয় দলের সাঁতারু। সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে জিতেছেন সর্বোচ্চ ৮টি সোনার পদক।

সমাজ থেকে পারিবারিক মূল্যবোধ যে হারিয়ে যাচ্ছে, সেটা ইদানীং পত্রিকার পাতা ওল্টালেই চোখে পড়ে। পরিবার প্রথা যেন ভেঙে যেতে বসেছে। হারিয়ে যাচ্ছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। পরিবারেও বড় হয়ে উঠছে ব্যক্তিত্বের সংঘাত। আসিফদের পরিবার যেন এসবের ঊর্ধ্বে। সবাই খেলাধুলার মানুষ বলেই কিনা এই পরিবারে নেই কোনো বিশৃঙ্খলা। আসিফের কথা, ‘আমাদের পরিবারে কোনো সংকট বা সমস্যা দেখা দিলে সবাই একসঙ্গে বসে আলোচনা করে গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নিই। আমার মায়ের ওপর সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিই।’

জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছেন আসিফের মা মর্জিনা খাতুন। মাঠে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেভাবে লড়াই করে জিতেছেন, জীবনযুদ্ধেও প্রতিটি ক্ষেত্রে সেভাবে লড়তে হয়েছে মর্জিনাকে।

এই সেই খেলাপাগল বাড়ি।
ছবি: প্রথম আলো

কুষ্টিয়ার আমলা সদরপুর ফুটবল মাঠে একসঙ্গে অনুশীলন করতেন মর্জিনা ও আনোয়ার। খেলার মাঠেই পরিচয়। সেখান থেকে ভালোলাগা। এরপর বিয়ে ১৯৯১ সালে। কিন্তু আনোয়ার হোসেনের পরিবার বিয়েটা মেনে নেয়নি। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে আনোয়ারকে নতুন করে শুরু করতে হয়েছে সবকিছু।

স্মৃতি হাতড়ে সেই কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন মর্জিনা, ‘বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ভীষণ অবহেলিত ছিলাম। আমাদের বিয়েটা মেনে নেয়নি শ্বশুরবাড়িতে। আমি যে খেলাধুলা করতাম, তা ওদের পরিবার থেকে কেউ চাইত না। সংসার চালাতে আনোয়ারকে শ্রমিকের কাজও করতে হয়েছে।’

মর্জিনা ছেলেমেয়েদেরও নিজের ইচ্ছাতেই খেলোয়াড় বানিয়েছেন। ছেলে আসিফ বিকেএসপিতে সুযোগ পেলে ভর্তির টাকা জোগাড় করতে পারছিলেন না। ওই সময় আত্মীয়স্বজনদের কাছে চেয়েও টাকা পাননি মর্জিনা, ‘আসিফের ভর্তির জন্য একটা টাকাও দেয়নি কেউ। আমার ভাইয়ের (সাঁতার কোচ আমিরুল ইসলাম) কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম।’ আসিফ বিকেএসপিতে পড়াশোনা শেষে নৌবাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন। একটু একটু করে দিন বদলেছে পরিবারের। গ্রামের অনেকে এখন আসিফদের পরিবারকে আদর্শ মানেন। আসিফ বাড়িতে গেলে প্রতিবেশীরা বলে, ‘আমার ছেলেকে যদি তোমার মতো সাঁতার শেখাতে, হয়তো ওরও একটা চাকরির ব্যবস্থা হতো।’

সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছেন আসিফের মা মর্জিনা খাতুন।
ছবি: প্রথম আলো

সামাজিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পেছনে পরিবারকেই কৃতিত্ব দেন আসিফ, ‘আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছি। প্রথমে যখন খেলা শুরু করি তখন পরিবারের অবস্থা ভালো ছিল না। প্রতিবেশীরা আমাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করত। বলত খেলে কী হবে? অথচ ওরাই এখন বলে, আমাদের পরিবারটাই নাকি গ্রামের সেরা। এর পেছনে আব্বু-আম্মুর অবদান অনেক।’

পরিবার যেকোনো মানুষের জন্যই বড় শিক্ষার জায়গা। দায়িত্ববোধের শিক্ষাটা পরিবার থেকেই পেয়েছেন আসিফ। পেয়েছেন সুশৃঙ্খল জীবন গড়ার শিক্ষা, ‘সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার অভ্যাসটা আমার এখনো রয়ে গেছে। কুষ্টিয়া গেলে এখনো সন্ধ্যায় মায়ের ফোন পাওয়ার আগেই বাড়ি ফিরি।’

আসিফদের পরিবারের ভালোবাসা আর মমতার বন্ধনটাও বেশ দৃঢ়। মাঝেমধ্যে সময় পেলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন সবাই মিলে। আসিফ বলছিলেন, ‘আমরা সবাই যখন ঢাকা থেকে বাড়িতে আসি, তখন কখনো কুষ্টিয়া শহরে, শিলাইদহে বা মুজিবনগর বেড়াতে যাই।’

পরিবার আসিফের কাছে বটগাছের ছায়ার মতো। সবাই আলাদাভাবে বেড়ে উঠলেও শিকড়টা এক জায়গায়। আসিফ বলছিলেন, ‘বিপদে–আপদে পরিবারই তো ছায়া হয়ে আমাদের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে যায়।’