ছেলেটির বাঁ হাতের অর্ধেকটা নেই, কিন্তু ডান হাত তো আছে!

প্রথম বিভাগ টেবিল টেনিস লিগে খেলছে সৌমিক মন্ডল।ছবি: শামসুল হক

অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে সৌমিক মণ্ডলের খেলার পার্থক্যটা দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।

১৩ বছরের এই কিশোর টেবিল টেনিস খেলোয়াড়ের পায়ের কাজ দুর্দান্ত। ব্যাকহ্যান্ড আর ফোরহ্যান্ড শটগুলোও অসাধারণ। ডিফেন্সও বেশ জমাট। ৮-১০ জন প্রতিশ্রুতিশীল টেবিল টেনিস খেলোয়াড়ের মতোই খেলে যাচ্ছে সৌমিক।

পল্টনে শহীদ তাজউদ্দীন স্টেডিয়ামে কাল থেকে শুরু হয়েছে মহানগরী টেবিল টেনিস লিগ। এখানে খেলতে এসে সবার নজর কেড়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী এই কিশোর।

কনুইয়ে বল রেখে সার্ভিস করছে সৌমিক
ছবি: শামসুল হক

তার বাঁ হাতের অর্ধেকটা নেই। কিন্তু তাতে কি! মনের অদম্য ইচ্ছাটা তো আছে, আর আছে ডান হাত। এই ডান হাত দিয়েই সুস্থ স্বাভাবিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছে সৌমিক।

এবার প্রথম বিভাগ টিটিতে প্রমিজিং জুনিয়র দলের হয়ে খেলছে নড়াইল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এই ছাত্র।

সার্ভিসে বল শূন্যে তোলার পর অ্যাকশনে সৌমিক
ছবি: শামসুল হক

সৌমিক উঠে এসেছে টেবিল টেনিসের উর্বর ভূমি নড়াইল থেকে। বাবা তুষার মণ্ডল ও মা রুপা মণ্ডল ছেলের জন্মের সময় বেশ ভয়ই পেয়েছিলেন। বাঁ হাতের অর্ধেকটা ছাড়াই জন্মায় সৌমিক।

ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েও বেশ শঙ্কিত ছিলেন মা–বাবা। কিন্তু সৌমিক দমে যাওয়ার পাত্র নয়। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলত। কিন্তু এক হাত দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট ধরতে বেশ কষ্ট হতো সৌমিকের। তাই ক্রিকেটের সঙ্গে আর জমেনি তাঁর।

টেবিল টেনিসের উর্বর–ভূমি নড়াইল থেকে উঠে এসেছে সৌমিক
ছবি: শামসুল হক

নড়াইল চৌরাস্তা পুরোনো সোনালী ব্যাংকের পাশে বাড়ি সৌমিকের। বাড়ির পাশেই টিটি ক্লাব। সেখানে অন্যদের টিটি খেলা দেখে সে নিজেও খেলতে চাইত।

জাতীয় দলের খেলোয়াড় সাদিয়া রহমান মৌয়ের মা শাহনাজ পারভীন তাকে খেলার জন্য উৎসাহ দেন। এরপর নিয়মিত টিটি ক্লাবে অনুশীলন করছে সে।

ঢাকায় এসে এরই মধ্যে দুটি ম্যাচ খেলেছে সৌমিক। এর মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের বিপক্ষে জিতেছেও সে।

দারুণভাবে কনুইয়ের ওপর বলের ভারসাম্য রেখে সার্ভ করতে পারে এই কিশোর
ছবি: শামসুল হক

প্রথমবার ঢাকায় টিটি খেলতে পেরে উচ্ছ্বসিত এই কিশোর, ‘এখানে এসে খেলতে খুব ভালো লাগছে।’

এক হাতের অর্ধেকটা না থাকলেও অন্য হাত দিয়ে দারুণভাবে কনুইয়ের ওপর বলের ভারসাম্য রেখে সার্ভ করে সৌমিক। আলাদা সতর্কতা নিয়েই খেলতে হয় তাঁকে।

অন্য স্বাভাবিক খেলোয়াড়ের চেয়ে সৌমিক অবশ্য কম যায় না, ‘আমি আসলে এভাবে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রথম দিকে একটু কষ্ট হতো। এখন সমস্যা হয় না।’

নিজেকে কখনোই অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে না সৌমিক
ছবি: শামসুল হক

নিজেকে কখনোই অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে না সে, ‘আসলে এটা (এক হাত না থাকাটা) আমার কাছে কিছুই মনে হয় না। স্কুলের বন্ধুরা এবং বাবা-মা সব সময় আমাকে সমর্থন দেন। এ জন্যই আমি নিয়মিত খেলতে পারছি।’

দলের অন্য সতীর্থরাও সৌমিককে খুব স্নেহ করে, ‘আমরা সবাই এখানে এসে ক্যাম্পের খেলোয়াড়দের সঙ্গে থাকছি। দলের অন্যরাও ম্যাচ জিততে চায়, আমিও সেটাই চাই। আমারও একই লক্ষ্য—কোর্টে নেমে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া। আমি ওদের মতোই সার্ভ করি, আমার কোনো সমস্যা হয় না।’

সৌমিকের খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত জাতীয় দলের কোচ
ছবি: শামসুল হক

সৌমিকের খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত জাতীয় দলের কোচ মোহাম্মদ আলী, ‘এই বয়সে ও যেভাবে খেলছে, তাতে অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো করছে। ফেডারেশন থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্যারা টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টেও তাকে খেলানো যেতে পারে। তাহলে জুনিয়র পর্যায়ে ওকে দিয়ে পদক জেতানো সম্ভব।’

পোল্যান্ডের প্রতিবন্ধী টিটি খেলোয়াড় নাতালিয়া পারতিকার নাম শোনেনি সৌমিক। নাতালিয়া এক হাত দিয়েই বিশ্ব জয় করেছেন ।

মাত্র ১১ বছর বয়সে নাতালিয়া সিডনি প্যারা-অলিম্পিকে খেলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ২০০৮ বেইজিং প্যারা অলিম্পিকে জেতেন সোনার পদক।

দেশের জন্য পদক জিততে চায় এই খুদে টেবিল টেনিস খেলোয়াড়
ছবি: শামসুল হক

সৌমিকও তেমনি অংশ নিতে চায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনতে চায় আন্তর্জাতিক পদক, ‘এবার ঢাকায় এসে টিটি খেলে আমার সাহস বেড়েছে অনেক। দেশের বাইরেও এখন টিটি খেলতে চাই। দেশের জন্য পদক জিততে চাই।’