জয়ের আনন্দে মিশে থাকে তাঁর ভাই হারানোর শোক

কেভিন করদনছবি: রয়টার্স

বাবা ছিলেন সাবেক ইংলিশ ফুটবলার কেভিন কিগানের ভক্ত। ছেলের জন্মের পর তাই প্রিয় ফুটবলারের নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রেখেছিলেন কেভিন করদন। কিন্তু ফুটবল নয়, করদন বেছে নিয়েছেন ব্যাডমিন্টন। গুয়াতেমালার এই শাটলার আর ইতিহাসের মাঝে মাত্র একটি জয়ের দূরত্ব।

আজ ব্যাডমিন্টনের ছেলেদের এককের কোয়ার্টার ফাইনালে করদন ২-০ সেটে হারিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার কাওয়ানগি হিওকে। আগামীকাল সেমিফাইনালে লড়বেন ২০১৬ রিও অলিম্পিকের ব্রোঞ্জজয়ী ডেনমার্কের ভিক্টর এক্সেলসেনের বিপক্ষে। এই ম্যাচটি জিতলেই করদন উঠে যাবেন স্বপ্নের ফাইনালে। যদি শেষ পর্যন্ত হেরেও যান তবু ব্রোঞ্জ জেতার সম্ভাবনা তো থাকছেই।

ব্রোঞ্জ, রুপা বা সোনা—যা–ই জিতুন না কেন করদন, তিনি হবেন গুয়াতেমালার অলিম্পিক ইতিহাসের দ্বিতীয় পদকজয়ী খেলোয়াড়। ভাইয়ের মৃত্যুশোককে শক্তি বানিয়েই টোকিওতে এগোচ্ছেন করদন।

কেভিন করদন
ছবি: রয়টার্স

গুয়াতেমালার হয়ে একমাত্র অলিম্পিক পদক জিতেছেন এরিক বারোন্দো। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ২০ কিলোমিটার রেসওয়াকে রুপা জিতেছিলেন বারোন্দো।

করদনের এত দূর উঠে আসার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। ৩৪ বছর বয়সী করদনের এটা চতুর্থ অলিম্পিক। ছোটবেলা থেকেই একজন অলিম্পিয়ান হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। শুধু অলিম্পিকে খেলবেন বলেই ব্যাডমিন্টন বেছে নিয়েছেন।

এবারের অলিম্পিকে গ্রুপ পর্বে বিশ্বের নবম স্থানে থাকা হংকংয়ের এনজি কা-লং আনগুসকে হারিয়ে সবাইকে চমকে দেন করদন। এর আগে হারিয়েছেন মেক্সিকোর লিনো মুনোজকে। শেষ ষোলোতে হারিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের শাটলার মার্ক কালজোওকে। আর আজ সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে হারিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার কাওয়ানগি হিওকে। শুধু এটুকু বললে যেন কম বোঝা যায় করদনের জয়ের মাহাত্ম্যটা। কাওয়ানগি এবার দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। বিশ্বের আগে বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় মোমোতা কেন্টোকে হারিয়েছেন কাওয়ানগি!

ভাইকে জয় উৎসর্গ করছেন করদন
ছবি: রয়টার্স

চারবার অলিম্পিকে খেলেছেন, তবে এবারই অলিম্পিকে সেরাটা দেখাচ্ছেন করদন। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে শেষ ষোলোয় গিয়ে ছিটকে পড়েছিলেন। আর ২০১৬ রিও অলিম্পিকে দুর্ভাগ্য সঙ্গী হয়েছিল, অ্যাঙ্কেলের চোটে পড়ে প্রথম ম্যাচেই নাম প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। দুঃসময় যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না করদনের। এরপর মারা যায় করদনের ভাই মারভিন। হতাশা তাকে এতটাই ঘিরে ধরেছিল যে একসময় মনে হতো খেলাটাই ছেড়ে দেবেন।

আবারও ব্যাডমিন্টনের কোর্টে ফিরতে পেরে উচ্ছ্বসিত করদন, ‘নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ বলে মনে হচ্ছে আমার। কারণ, আমার ভাই মারা যাওয়ার ঘটনা এবং বাজে একটা চোটের পরও ফিরে আসতে পেরেছি কোর্টে। এখন যেন আমি একজন নতুন মানুষ।’

এবারের অলিম্পিকে প্রতিটি জয়ের পর আকাশের দিকে চেয়ে উল্লাস করেছেন, আর জয় উৎসর্গ করেছেন ভাইকে।

কেভিন করদন
ছবি: রয়টার্স

গুয়াতেমালার ছোট্ট শহর জাকাপায় জন্ম করদনের। কিন্তু সেখানে ছিল না অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। তাই তো নিজের শহর ছেড়ে প্রায় ১১২ কিলোমিটার দূরে রাজধানী গুয়াতেমালা সিটিতে বছরের পর বছর থেকেছেন। সেখানেই নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করেছেন। এমন এক দেশে ব্যাডমিন্টন খেলছেন, যেখানে এ খেলা খুব একটা আগ্রহ জাগায় না। এ খেলার কোনো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসও নেই দেশটির।
স্বপ্ন সত্যি করতেই ব্যাডমিন্টন খেলাটা বেছে নিয়েছেন করদন, ‘আমি অলিম্পিকে খেলব বলেই ব্যাডমিন্টনকে বেছে নিয়েছি। ২০০৮ সালে প্রথমবার বেইজিংয়ে খেলার সুযোগ পাই। এটা আমার চতুর্থ গেমস। এখনো সেই একই স্বপ্ন নিয়েই খেলে যাচ্ছি। এবং আগের চেয়েও বেশি উপভোগ করছি খেলাটা।’

করদনের বয়স এখন ৩৪। কিন্তু ২১ বছর বয়সেই বেইজিংয়ের অলিম্পিক গেমসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গুয়াতেমালার পতাকাবাহক ছিলেন। এর চেয়ে বড় সম্মান আর কীই-বা হতে পারে?

আর একটি জয়ের অপেক্ষা করদনের
ছবি: রয়টার্স

ভাইয়ের অকালমৃত্যু আর চোট কিছুদিনের জন্য যেন থামিয়েই দিয়েছিল করদনকে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। স্বাভাবিক জীবনে আবারও ফিরতে পেরেই খুশি করদন, ‘জীবন কিন্তু এরপরও ঠিকই এগিয়ে চলেছে। এবং আপনি যখন ঈশ্বরে বিশ্বাস করবেন তখন এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে ঠিকই বেরিয়ে আসতে পারবেন।’

অলিম্পিকে এখন পর্যন্ত পদক জিতেননি। কিন্তু করদনের শোকেস–ভর্তি আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপের পদকে। প্যান আমেরিকান গেমসে ২০১১ ও ২০১৫ সালে জিতেছেন সোনা। ২০০৭ সালে রুপা এবং ২০১৯ সালে জেতেন ব্রোঞ্জ। কিন্তু ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সোনালি সময়টা বোধ হয় এই অলিম্পিকেই কাটাচ্ছেন করদন। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পরও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না করদনের। যেন ঘোরের মধ্যে আছেন এখনো, ‘যখন প্রথমবার অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পেলাম তখন মনে হতো যদি সেখানে গিয়ে একটা ম্যাচ খেলতে পারতাম। তাহলেই আমার স্বপ্ন সত্যি হতো। এরপর আমি আরও বেশি ম্যাচ জেতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমি এখানে এরই মধ্যে তিনটা ম্যাচ জিতেছি। কিন্তু আমার যেন এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’

আর একটা জয়েই যে ইতিহাস গড়ে ফেলবেন করদন। ইতিহাস গড়তে যে তর সইছে না করদনের, সেটা তো না বললেও চলে।