পুস্কর, নিলয়েরা যখন হকি সংগঠক

মাঠে নামর আশায় সারা বছর চেয়ে থাকেন এই হকি খেলোয়াড়েরাছবি: তানভীর আহম্মেদ

যে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল কোনো ক্রীড়া সংগঠকের, সেই কাজগুলোই করতে হচ্ছে জাতীয় হকি দলের খেলোয়াড়দের! মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে ১৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে শহীদ স্মৃতি হকি টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টে খেলবেন বলে পুস্কর খীসা, হাসান জুবায়ের নিলয়, আবু সাঈদ নিপ্পনেরা হয়ে গেলেন ক্রীড়া সংগঠক। টুর্নামেন্টের জন্য দল গড়া, খেলোয়াড় বাছাই, ফেডারেশনের কাছে নিবন্ধনের জন্য অনুমতি, স্পনসর জোগাড়—এর সবই যে করতে হয়েছে খেলোয়াড়দের।

এমনিতেই স্থবির হয়ে আছে ঘরোয়া হকি। প্রিমিয়ার লিগ নেই বলে খেলোয়াড়দের আয়রোজগার বন্ধ। সর্বশেষ লিগ হয়েছিল ২০১৮ সালের জুনে। এই যখন অবস্থা, তখন ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতেও খেলার সুযোগ মিলছে না অনেকের। শুরুতে শুধু সার্ভিসেস দলগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে শহীদ স্মৃতি হকি টুর্নামেন্ট মাঠে গড়ানোর পরিকল্পনা ছিল ফেডারেশনের। কিন্তু সার্ভিসেস দলগুলোর বাইরেও যেসব খেলোয়াড়েরা অলস সময় কাটাচ্ছেন, তাঁদের খেলার সুযোগ তৈরি করে দিতেই জাতীয় চার নেতার অন্যতম এ এইচ এম কামারুজ্জামানের নামে হকি দল গড়ার পরিকল্পনা করেন এই খেলোয়াড়েরা।

দলের অধিনায়ক জাতীয় দলের স্ট্রাইকার পুস্কর খীসা বলছিলেন, ‘আমরা আর কত দিন বসে থাকব? খেলতে না পেরে বসে থাকার যে যন্ত্রণা, তা আমাদের চেয়ে বেশি আর কেউ বুঝবে না। আমাদের অন্য সতীর্থরা নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনীতে খেলছে। অথচ আমাদের সেটা চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে। এ জন্যই কয়েকজন মিলে পরিকল্পনা করি একটা দল গড়ার।’

খেলার পর আড্ডার মেতে উঠেছেন পুস্কর–নিলয়রা।
ছবি: প্রথম আলো

কিন্তু চাইলেই তো আর দল গড়া সম্ভব নয়। ফেডারেশনের অনুমতি মিলতে হবে। খেলার জন্য দলের নাম নিবন্ধন করতে হবে। পাশাপাশি দলের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা জোগাড়ের চ্যালেঞ্জও ছিল। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকভাবে আয়োজন করে মাঠে দল নামাতে পেরেছেন পুস্কর-নিলয়েরা। এই দলের জন্য স্পনসর করতে এগিয়ে আসেন রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য জানে আলম খান।

খেলোয়াড়দের অসহায় অবস্থার কথা শুনেই এই ক্রীড়া সংগঠক পুরো দলের স্পনসরের দায়িত্ব নেন, ‘আমি নিজেও একজন হকি খেলোয়াড় ছিলাম। এই খেলোয়াড়দের কষ্ট আমি বুঝি। যখন দেখলাম উত্তরবঙ্গের কোনো দল নেই, তখন এই দল গড়ার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসি। তা ছাড়া এই দলের অনেকে আমার পরিচিত। তাই দল চালানোর সব দায়িত্ব আমি নিয়েছি। ভবিষ্যতেও এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখব।’

যদিও কামারুজ্জামান স্মৃতি সংঘ টুর্নামেন্টের অন্য দলগুলোর তুলনায় বেশ কষ্ট করে খেলায় অংশ নিচ্ছে। ফেডারেশনের ডরমিটরির মাত্র দুই কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন ১৮ জন খেলোয়াড়। খাবারদাবারের সুব্যবস্থা নেই। গুলিস্তানের রেস্তোরাঁ থেকে খাবার এনে ডরমিটরিতে খেতে হচ্ছে। অনুশীলনের জন্যও সেভাবে ফেডারেশন থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করলেন জাতীয় দলের ফরোয়ার্ড হাসান জুবায়ের নিলয়, ‘আমরা ফেডারেশনের কাছে বল চেয়েও পাইনি। মাত্র ১০টা বল দিয়েছে। এত অল্প বল দিয়ে কি অনুশীলন করা সম্ভব?’

যেভাবেই হোক খেলতে পারলেই খুশি। যদি বসে থাকি তাহলে দুই দিন পর জাতীয় দলে ডাকলে বলবে ফিট নেই। কিন্তু পেছনের গল্প কেউ জানতে চাইবে না।
হাসান জুবায়ের নিলয়, জাতীয় দলের হকি খেলোয়াড়

তারপরও সার্ভিসেস দলগুলোর সঙ্গে লড়াই করে মাঠ ছাড়ছেন খেলোয়াড়েরা। উদ্বোধনী ম্যাচে নৌবাহিনীর সঙ্গে শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে ২-২ ড্র করে এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্মৃতি সংঘ। জাতীয় দলের গোলরক্ষক আবু সাঈদ নিপ্পন এই পারফরম্যান্সেও খুশি, ‘আমরা নেভির মতো সুযোগ-সুবিধা পাই না। মাত্র দুই দিন অনুশীলন করতে পেরেছি। তবুও ওদের সঙ্গে মাঠে সমান তালে লড়াই করেছি। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় কিছু।’

ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এএইচএম কামারুজ্জামান স্মৃতি সংঘের খেলোয়াড়েরা।
ছবি: বাহফে

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় কোনো প্রতিযোগিতায় জাতীয় দল সর্বশেষ খেলেছিল ২০১৮ সালে। জাকার্তা এশিয়ান গেমসের পর পরের বছর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য খেলেছিল থাইল্যান্ডে এশিয়ান ইনডোরের মতো ফেস্টিভ্যাল টুর্নামেন্টে। এরপর গত নভেম্বরে হয়েছে প্রেসিডেন্টস কাপ হকি, ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের টুর্নামেন্ট। এ বছরে হওয়া এই একমাত্র টুর্নামেন্টেও সার্ভিসেস দলগুলোর বাইরে মাত্র ২০ জন সাধারণ খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পেয়েছেন কামারুজ্জামান স্মৃতি সংঘ দল গড়ায়।

ফেডারেশন আগামী মে মাসে ফ্র্যাঞ্চাইজি হকি লিগের আয়োজন করতে চায়। ওই টুর্নামেন্টে খেলতে হলেও নিজেদের ফিট রাখাটা জরুরি বলে মনে করেন নিলয়, ‘আমরা সারা বছর খেলতে চাই। যেভাবেই হোক খেলতে পারলেই খুশি। যদি বসে থাকি তাহলে দুই দিন পর জাতীয় দলে ডাকলে বলবে ফিট নেই। কিন্তু পেছনের গল্প কেউ জানতে চাইবে না। তা ছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হবে বলে শুনেছি। সেখানে খেলতে হলেও নিজেকে ফিট রাখতে হবে।’