অ্যাথলেটদের প্রাপ্তির খাতায় শুধুই শূন্যতা

অ্যাথলেটের জীবনে আর্থিক প্রাপ্তির খাতাটা শূন্য।ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের শীর্ষ স্তরের ক্রিকেটারদের আয় বছরে কয়েক কোটি টাকা। শীর্ষ ফুটবলারদের ক্ষেত্রে অঙ্কটা অন্তত ৫০-৬০ লাখ টাকা তো বটেই। অথচ একজন প্রতিষ্ঠিত অ্যাথলেটের আয়ও বছরে মেরেকেটে ৫-৬ লাখ টাকার বেশি নয়।
বিশ্ব অ্যাথলেটিকস দিবস ঘিরে অ্যাথলেটিকস দুনিয়া যত উৎসবমুখরই থাকুক, বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে যে দিবসটি উপলক্ষে কিছু হয় না, তা নয়।

অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের উদ্যোগে শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতা হয় প্রতিবছর। এবার করোনার কারণে তা-ও হচ্ছে না। আর হলেই কী! যে দেশের অ্যাথলেটদের জীবন দুঃখ-দুর্দশায় মোড়ানো, সেই দেশে অ্যাথলেটিকস দিবস উদ্‌যাপন কখনো কখনো প্রহসনের মতোই দেখায়।

সাবেক অ্যাথলেট শামীমা সাত্তার মিমু দুঃখ করে বলছিলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ অ্যাথলেটের জীবনে আর্থিক প্রাপ্তির খাতাটা শূন্য। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না এলে অ্যাথলেটিকসের প্রতি নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা কঠিন।’ নতুন প্রজন্মকে অ্যাথলেটিকসে আগ্রহী করতেই ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিবছর মে মাসে বিশ্ব অ্যাথলেটিকস দিবস উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে। কয়েক বছর ধরেই ৭ মে, অর্থাৎ আজকের দিনে দিবসটি উদ্‌যাপন করছে বিশ্ব অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন। এ বছর অবশ্য বিশ্ব অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন দিনটি উদ্‌যাপন করেছে ৫ মে।

ভালো নেই কেউ।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের আর্থসামাজিক অবস্থা অন্য দেশের অ্যাথলেটদের মতো নয়। যাঁরা একটু ভালো অ্যাথলেট, তাঁরা হয়তো কোনো একটি সংস্থা বা বাহিনীতে মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে কোনোমতে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু সেই চাকরির সুযোগও এখন কমে গেছে। বিজেএমসি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় আড়াই শ অ্যাথলেট পড়েছেন মহা সংকটে।

এখানে তেমন টাকাপয়সা নেই। শুধু জাতীয় দলের ক্যাম্প হলে ফেডারেশন মাসে ৮-১০ হাজার টাকা দেয়।
মেজবাহ আহমেদ, সাবেক দ্রুততম মানব

জাতীয় প্রতিযোগিতায় হার্ডলসে রুপাজয়ী নোয়াখালীর অ্যাথলেট কেয়া আক্তার ও ৪০০ মিটারে রুপাজয়ী একই জেলার নাসরিন আক্তার সে রকম দুই অ্যাথলেট। এ দুজন এতটাই অর্থকষ্টে আছেন যে তাঁদের নাম উঠে গেছে দুস্থ ক্রীড়াবিদের তালিকায়! নোয়াখালীর অ্যাথলেটিকস কোচ রফিক উল্ল্যা আক্তার জানিয়েছেন, করোনার সংকটকালে তিনি তাঁদের নাম পাঠিয়েছেন বঙ্গবন্ধু দুস্থ ক্রীড়াবিদ ভাতার জন্য। তবে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের আর্থিক তহবিল থেকে নাকি কিছুই পাননি কেয়া ও নাসরিন।

১৭ বারের দ্রুততম মানবী নাজমুন নাহার বিউটি নোয়াখালী থেকে ফোনে বলছিলেন, ‘বিজেএমসির অ্যাথলেটরা ছিল পেটেভাতে। এখন তো সংস্থাটিই নেই। অ্যাথলেটরা মানবেতর জীবন যাপন করছে।’ তবে নিজের জীবন থেকে শিখে সব অ্যাথলেটকে একটা পরামর্শ দিয়েছেন তিনি, ‘আমি লেখাপড়া করে আজ একটা জায়গায় আসতে পেরেছি। বর্তমান দ্রুততম মানবী শিরিনও লেখাপড়া করছে। আমি বলব, সবাই যেন লেখাপড়া করে। নইলে জীবনে ধুঁকতে হবে।’

বাংলাদেশ গেমসের দ্রুততম মানব ও মানবী হয়েছেন মোহাম্মদ ইসমাইল ও শিরিন আক্তার।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বিউটির মতো পড়াশোনা করে ভালো আছেন ১২ বারের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারও। তবে তৃণমূলের অ্যাথলেটদের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে দুঃখ করলেন তিনি, ‌‘মহামারিতে সংকট তৈরি হয়েছে। জেলা পর্যায়ের অ্যাথলেটরা ভালো নেই।’ সাতবারের দ্রুততম মানব মেজবাহ আহমেদও অ্যাথলেটদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে হতাশ, ‘চাকরির আশায় মূলত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই অ্যাথলেটিকসে আসে। কিন্তু এখানে তেমন টাকাপয়সা নেই। শুধু জাতীয় দলের ক্যাম্প হলে ফেডারেশন মাসে ৮-১০ হাজার টাকা দেয়। এ ছাড়া তিন বাহিনীর কেউ বিদেশ গেলে তারা কিছু ভাতা পায়, এই যা।’

যে কয়জন অ্যাথলেট কিছুটা ভালো আছেন, সেটা বিভিন্ন বাহিনী বা সংস্থার বদৌলতেই। নইলে অ্যাথলেটদের অবস্থা আরও শোচনীয় হতো বলেই মনে করেন বর্তমানে দেশের দ্রুততম মানব নৌবাহিনীর মোহাম্মদ ইসমাইল, ‘সমাজে আমাদের মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো ব্যবস্থা করে দিচ্ছে বিভিন্ন বাহিনী। নইলে অ্যাথলেটিকসে অর্থ যেমন নেই, প্রচার-প্রচারণাও কম। অ্যাথলেটরা সব দিক থেকেই অবহেলিত।’

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেটে সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দোকানটি ১১ বছরেও বুঝে পাইনি।
সাফ সোনাজয়ী মাহবুব আলমের স্ত্রী স্বপ্না আক্তার

ট্র্যাক থেকে বিদায় নেওয়া অ্যাথলেটদের গল্পটাও একই। খেলোয়াড়ি জীবনের সীমিত আয়ে ভবিষ্যতের জন্য আসলে কিছুই করতে পারেন না তাঁরা। ১৯৯০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো দক্ষিণ এশিয়ার দুবারের দ্রুততম মানব প্রয়াত শাহ আলমের স্ত্রী আফরোজা বেগম মেহেরপুর থেকে ফোনে বলছিলেন, ‘টাকার অভাবে ছেলেকে বিবিএ এবং দুই মেয়েকে ম্যাট্রিকের পর পড়াতে পারিনি। ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে আমাদের একটি দোকান দেওয়া হয়েছে। সেটার ভাড়া পাই ১২ হাজার টাকা। কিন্তু করোনার কারণে তিন-চার মাস ধরে ভাড়াও পাচ্ছি না।’

দেশের হয়ে খেলে, ট্র্যাকে দাপিয়ে বেড়িয়েও তাঁদের নেই কোনো সামাজিক স্বীকৃতি।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

শাহ আলমের পরিবার তবু সরকারের কাছ থেকে দোকান পেয়েছে। সাফ গেমসে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনাজয়ী মাহবুব আলমের পরিবার তা-ও পায়নি। ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মাহবুবের স্ত্রী স্বপ্না আক্তারের ক্ষোভ, ‘বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেটে সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দোকানটি ১১ বছরেও বুঝে পাইনি। সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয় সাহেবের কাছে অনেকবার গিয়েও কোনো কাজ হয়নি।’

অথচ এই সমস্যায়ই যদি আজ একজন ক্রিকেটারের পরিবার পড়ত, সেটির সমাধান হয়তো দ্রুতই হয়ে যেত। অ্যাথলেটদের ক্ষোভটা এই জায়গাতেও। দেশের হয়ে খেলে, ট্র্যাকে দাপিয়ে বেড়িয়েও তাঁদের নেই কোনো সামাজিক স্বীকৃতি। ভুগতে হয় পরিচয়সংকটে। নৌবাহিনীর লংজাম্পার আল আমিনের আক্ষেপ, ‘১৬ বছর ধরে জাতীয় স্তরে সোনা পেয়েও কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে নিজের এলাকায় আজ পর্যন্ত একটা সংবর্ধনা পাইনি।’

অ্যাথলেটিকস দিবসেও তাই বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস যেন হতাশারই প্রতিচ্ছবি।